টপিকঃ ঘুম কুমারী রোজালিয়া
স্লিপিং বিউটি বা ঘুম কুমারির গল্প আমরা কমবেশি সবাই পড়েছি । সেই যে এক মিষ্টি রাজকন্যা ,দুষ্টু পরী যাকে মন্ত্র বলে ঘুম পাড়িয়ে রাখে অনেক দিন ধরে । আহ তারপর এক রাজার কুমার এসে ঘুম ভাঙ্গায় সেই রাজকন্যার । রূপকথা ... রূপকথা । তবে বাস্তব কখনও কখনও রূপকথাকেও হার মানায় ।
এই পৃথিবীতেই আছে এক মিষ্টি ছোট্ট ঘুমকুমারি । যাকে দেখলে যার গল্প শুনলে নিজের অজান্তেই চোখ ভিজে যায় নোনাজলে । এখানে নেই কোন দুষ্ট পরি কিংবা সুদর্শন রাজকুমার । কারও পরশেই ভাঙবে না এই ঘুম কুমারীর ঘুম । এ গল্প নিয়তির কাছে পরাজিত এক বাবার গল্প ,এক সন্তানের গল্প আর এক মমিকরন বিশেষজ্ঞ এর গল্প ।
প্রতিটা মেয়েই তার বাবার কাছে রাজকন্যা আর সন্তানের প্রতি পিতৃ স্নেহ যে কি প্রবল তার জ্বলন্ত উদাহরণ এই বাস্তব জগতের ঘুম কুমারী বা স্লিপিং বিউটি ।
রোজালিয়া লম্বারদো ... এক মিষ্টি ইতালিয়ান মেয়ের নাম । বয়স মোটে দুই বৎসর ।খিল খিল করে হেসে খেলে সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখাই ছিল তার কাজ । বাবার চোখের মনি আদরের কন্যা ফুটফুটে মিষ্টি মেয়ে হঠাত আক্রান্ত হল নিউমনিয়ায় । ১৯১৮ সালের ১৩ ডিসেম্বর ইতালির সিসিলির পালেরমো তে জন্ম নেয়া রোজালিয়া মাত্র দুই বৎসর বয়সে ১৯২০ সালের ৬ ডিসেম্বর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ।
মেয়ের এই আকস্মিক আর অকাল মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না জেনারেল মারিও লম্বারদো । তার ছোট্ট ফুটফুটে মেয়েটিকে কফিনে ভরে মাটির নিচে অন্ধকার ঘরে রেখে দেয়া হবে আর ধীরে ধীরে তা মিশে যাবে মাটির সাথে ভাবতেই পারছিলেন না কন্যা স্নেহে অন্ধ পিতা ।
জেনারেল মারিও লম্বারদো
মারিও লম্বারদো চাইলেন মেয়েকে চিরদিন তার চোখের সামনে রাখতে । তাই তিনি শরণাপন্ন হলেন বিখ্যাত মমিকরন বিশেষজ্ঞ অ্যালফ্রেড সালাফিয়ার । অ্যালফ্রেড সালাফিয়া ছিলেন মমিকরনে বিশেষজ্ঞ ।
তার বিশেষ প্রক্রিয়ায় মমিকরনের কারনে আজও প্রায় অক্ষত আছে রোজালিয়ার দেহ। কাচের কফিনে ঢাকা ছোট্ট রোজালিয়া শায়িত আছে ছোট এক চ্যাপেলে ।ইতালির সিসিলির কাপুচিন কাটাকম্ব অফ পালেরমোতে (বিশেষ ধরনের উন্মুক্ত সমাধিস্থল) রোজালিয়া হল সর্বশেষ সমাহিত বা সংরক্ষিত মানব সন্তান ।
এক্সরে রিপোর্টে দেখা গেছে যে রোজালিয়ার দেহের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ প্রত্যঙ্গ প্রায় অক্ষত আছে । সম্প্রতি অ্যালফ্রেড সালাফিয়ার হাতে লেখা স্মৃতি কথা থেকে প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে তিনি রোজালিয়ার দেহ সংরক্ষণের জন্য তার দেহের অভ্যন্তরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গে ফরমালিন ইনজেক্ট করেছিলেন যাতে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমন না হয় । শরীরকে শুকনা /শুষ্ক রাখার জন্য অ্যালকোহল আর একি সাথে প্রয়োজনীয় আদ্রতার জন্য গ্লিসারিন ব্যাবহার করেছিলেন ।
সম্প্রতি(২০১৪) ইতালিয়ান গবেষকরা দাবি করেছেন যে এই স্লিপিং বিউটি তার চোখ প্রতিদিন খুলে আর বন্ধ করে । এটা নিয়ে সিসিলিতে অনেক রকম গল্প ও প্রচলিত আছে ।
তবে কাপুচিন কাটাকম্বস এর কিউরেটর ইতালিয়ান গবেষকদের দাবি নাকচ করে দিয়ে বলেছেন এটা দৃষ্টি বিভ্রম । কাচের কফিনে আলো পড়ার কারনে এমনটা মনে হয় ।
২০১০ এ ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিন আর ২০১৪ তে ডিসকভারি চ্যানেল এর এক বিশেষ দল রোজালিয়ার উপর বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে । তাদের মতে বর্তমানে এর মাঝে হালকা পচনের লক্ষন দেখা যাচ্ছে যদিও তা দৃশ্যমান নয় ।
প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক ভীর জমায় একনজর দেখার জন্য এই ঘুম কুমারীকে । কাচের কফিনে শায়িত সোনালি চুলে বো বাধা মিষ্টি মেয়ে রোজালিয়া লম্বারদো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর এবং অবিকৃত মমি।
তথ্য সূত্রঃ
১। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিন
২। ডিসকভারি চ্যানেল
৩। ছবিগুলো গুগল থেকে সংগৃহীত