টপিকঃ আবার একটি যুদ্ধ চাই
অবক্ষয় শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘বিনাশ, হানি, ক্ষয় বা ক্ষয়প্রাপ্তি’। সামাজিক মূল্যবোধ তথা সততা, কর্তব্য নিষ্ঠা, ধৈর্র্য, উদারতা, শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, নান্দনিক সৃজনশীলতা, দেশপ্রেম, কল্যাণবোধ, পারস্পরিক মমত্ববোধ ইত্যাদি নৈতিক গুণাবলী লোপ পাওয়া বা নষ্ট হয়ে যাওয়াকে সামাজিক অবক্ষয় হিসেবে অভিহিত করা হয়। সামাজিক অবক্ষয় রোধে, সমাজের সর্বস্তরে দেশপ্রেম জাগ্রত করতে আবার একটি যুদ্ধ চাই। ¤্রয়িমান বিবেক ও মানবতাবোধ জাগ্রত করতে এবং ধংসাতœক ধারা, খুন-খারাবি নৃশংস কর্মকান্ড, অনিয়ম-দুর্নীতি প্রতিরোধে আবার একটি যুদ্ধ চাই।
মহান স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও বর্তমান সময়ে আমাদের সমাজের কেমনতর অবয়ব তা সচেতন সামাজিক মাত্রেরই জানা। নানাবিধ অপরিহার্য শত ব্যস্ততা সত্বেও নিজ স্বার্থেই আপন চেহারা অবলোকন করে নেয়া একান্ত বাঞ্ছনীয়। আমাদের বর্তমান সমাজ কাঠামো ক্ষেত্রবিশেষে কেমন অবস্থায় রয়েছে- ক্ষেত্রবিশেষ বলতে দেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, রাজনৈতিক অবস্থা, অন্ন, বস্ত্র, আবাসন, স্বাস্থ্য, শিক্ষাক্ষেত্রের মূল্যবোধ ইত্যাদি মৌলিক ক্ষেত্রে ইঙ্গিত গ্রহনীয়।
ঐতিহাসিক বইপত্রে দেখা যায়, স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭৪ সালে দেশের ‘দুর্ভিক্ষ’ দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত করে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে বিব্রত করতে ৫০ টাকার বিনিময়ে শরীরে মাছ ধরার জাল জড়িয়ে লজ্জা নিবারনের ‘বাসন্তি’ নাটকের মঞ্চায়ন ও
১৯৭১ সালে কনসার্ট ফর বাংলাদেশের পোস্টার থেকে ছবি নিয়ে সেটা দূর্ভিক্ষের ছবি বলে চালানোর মধ্য দিয়ে ওই সময়ে মিডিয়া চরিত্রের অবক্ষয়ের সূত্রপাত ঘটে বলে মনেকরি।
ঐতিহাসিক বইপত্রে দেখা যায়, গবেষক ও রাজনীতিক এমএ মোহায়মেন তার ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামীলীগ’ নামক বইয়ে লিখেছেন, ‘দেশ স্বাধীনের দুদিনেই শুরু হল হরিলুট। শিল্প কারখানায় অস্তিত্বহীন শ্রমিকের নামে মাহিনা লুট, পাটকলগুলিতে যন্ত্রাংশ ক্রয়ের নামে লুট, বস্ত্রশিল্পে তুলা ও সুতা কেনায় কোটি কোটি টাকা লুট, ১৯৭১ এর অবাঙ্গালীদের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে লুট, ১৬ ডিভিশন নামের ভূয়া মুক্তিযোদ্ধার নামে সরকারী সম্পদ লুট’। (এম এ মোহায়মেন: বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামীলীগ, পৃ ১৪, ৪৪)। ওই সময়ের সার্বিক অবক্ষয় দেখে জাতির জনক বলেছিলেন দুর্নীতি নির্মূল করতে হবে। মাঝে মাঝে আমরাও অমানুষ হয়ে যাই। আমরা এত রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছি তবু অনেকের চরিত্রের পরিবর্তন হয়নি ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবারী আর মুনাফাখোরেরা বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের জীবন অতিষ্ট করে তুলেছে। …..বিদেশি সাহায্য যে সামান্য পরিমাণে আসে তাও চোর-চোট্টা আর আটপাররা ভাগবাটোয়ারা করে খায়। ……..দীর্ঘ তিন বছর আমি তাদের কাছে অনুরোধ এবং আবেদন জানিয়েছি তাদের হুমকি দিয়েছি কিন্তু চোরা নাহি শোনে ধর্মের কাহিনী। তাই আর অনুরোধ নয় হুমকি নয়। এবার বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচাতে হবে। তাদের জন্য আমি আমার জীবন কারাগারে কাটিয়ে দিয়েছি তাদের দুঃখ দেখলে আমি পাগল হয়ে যাই। তাই আজ আমি প্রতিজ্ঞা করছি বাংলাদেশের মাটি থেকে ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, মোনাফাখোর আর চোরাকারবারীদের নির্মূল করবো (১৯৭৫ সালের ১১ জানুয়ারি কুমিল্লা সামরিক প্রশিক্ষণ একাডেমীতে শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠানে বিদায়ী ক্যাডেটদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষন)। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, মোনাফাখোর আর চোরাকারবারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। এর সাত মাসের মাথায় জাতির জনককে নির্মম-নৃশংসভাবে সপরিবারে হত্যা করে বিপথগামী সেনা অফিসাররা। জাতির জনকের সেই অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করতে আবার একটি যুদ্ধ চাই।
ফিরে তাকালে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে মহান মুক্তিযুদ্ধের জ্বলজ্বলে দিনগুলো। ১৯৭১ সালে আমার বয়সই বা কত? ইংলিশ প্যান্ট বা হাফ প্যান্ট পড়া বয়স। সবকিছু স্পষ্ট দেখলেও বোধবুদ্ধি হয়নি। বাপ-চাচাদের মধ্যে বংশের বড় ছেলে বলে আদরের কমতি ছিলনা। সে সূত্রেই টাঙ্গাইলের কালিহাতীর বল্লা গ্রামের দুলাল, মেহের, শাহাদৎ, রশিদ, আসাদ কাকাদের আনুকূল্যে মুক্তিযোদ্ধাদের বাংকারে বাংকারে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। সে আরেকদিন বলা যাবে।
৪৬তম মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের এ লগ্নে মহান মুক্তিযুদ্ধে টাঙ্গাইলের অবস্থানটা একটু স্মরণে নিতে চাই, জানাতে চাই নতুন প্রজন্মকে একই সঙ্গে অবক্ষয় রোধে আবার একটি যুদ্ধ চাই।
স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্ব গাঁথা টাঙ্গাইলের ইতিহাস ও ঐতিহ্য স্মরণীয়। টাঙ্গাইলে অবস্থানকারী কৃর্তিমান লৌহমানব মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, আব্দুল মান্নান, শামসুর রহমান খান, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, হাতেম তালুকদার, ফজলুর রহমান ফারুক, তোফাজ্জল হোসেন মুকুল, ইনসান মোক্তার, সেতাব মোক্তার, আব্দুল বাছিদ সিদ্দিকী, হুমায়ুন খালিদ, খন্দকার আসাদুজ্জামান, বদিউজ্জামান, একমাত্র মহিলা হাজেরা সুলতানার অবদান অবিস্মরণীয় ও ঐতিহাসিক। অকুতভয় সৈনিক আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কাদেরিয়া বাহিনীর গেরিলা যুদ্ধ মহান মুক্তিযুদ্ধে এক বিরণ দৃষ্টান্ত ও কিংবদন্তি। কাদেরিয়া বাহিনীর গেরিলা যুদ্ধ ইতিহাসের পাদপীঠে স্থান করে নিয়েছে।
তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে এই বিশাল কাদেরিয়া বাহিনী। স্বাধীনতার ৯ মাসে দেশের ভেতরে থেকে বেসামরিক গেরিলাযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী গড়ে তোলেন ১৭ হাজার নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধা ও ৭০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে এই বিশাল বাহিনী। কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে পরিচালিত হয় অসাধারণ গেরিলাযুদ্ধ এবং বেশ কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধ। টাঙ্গাইল ও পাশের তিনটি জেলা ঢাকা, ময়মনসিংহ ও পাবনার বিস্তীর্ণ এলাকায় কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা একের পর এক আঘাত হেনে হানাদার বাহিনীকে পর্যুদস্ত করেন। এই বাহিনীর হেডকোয়ার্টার ছিল টাঙ্গাইলের সখীপুরের প্রত্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চলে। এখানে আন্ধি গ্রামে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এই কেন্দ্রের দায়িত্বে ছিলেন শওকত মোমেন শাহজাহান। কাদেরিয়া বাহিনীর সামরিক শাখার পাশাপাশি বেসামরিক বিভাগও ছিল। এই বিভাগের প্রধান ছিলেন আনোয়ার উল আলম শহীদ। বিভিন্ন আঞ্চলিক বেসামরিক বিভাগের দায়িত্ব পালন করেন আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিম, মোয়াজ্জেম হোসেন খান ও খন্দকার নূরুল ইসলাম। জুন মাসের শেষের দিকে কাদেরিয়া বাহিনীর আন্ধি হেডকোয়ার্টার থেকে আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিমকে প্রশাসকের দায়িত্ব দিয়ে ভূঞাপুর, গোপালপুর ও টাঙ্গাইলের যমুনা নদীর চরাঞ্চলে যুদ্ধের জন্য অবস্থান গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়।
কাদেরিয়া বাহিনী পরিচালিত হতো সামরিক কায়দায়। এই বাহিনীর হেডকোয়ার্টার সন্নিহিত মুক্তাঞ্চলে হাসপাতালও স্থাপন করা হয়েছিল। সেখানে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দেয়া হতো। বাহিনীর ছিল অর্থ বিভাগ, জনসংযোগ বিভাগ, বেতার-টেলিফোন-যোগাযোগ বিভাগ, খাদ্য বিভাগ এবং বিচার ও কারাগার বিভাগ। টাঙ্গাইলের মুক্তিযোদ্ধারা অসংখ্য গেরিলাযুদ্ধসহ বেশ কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। তাৎপর্যের বিষয় হলো, অধিকাংশ যুদ্ধেই তাঁরা সফল হন। কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে অসংখ্য হানাদার সেনা ও তাদের দোসর নিহত ও আহত হয়। যুদ্ধ করতে গিয়ে শহীদ হন এই বাহিনীর অনেক মুক্তিযোদ্ধাও। ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৭০টি যুদ্ধে অংশ নেয় কাদেরিয়া বাহিনী। সম্মুখযুদ্ধগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মাকড়াই, ধলাপাড়া, কামুটিয়া, বল্লা, ফুলতলা, বাথুলি, পাথরঘাটা ও ঘাটাইলের যুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনী ভূঞাপুরের অদূরে পাকিস্তানি সেনাদের যুদ্ধ জাহাজ ধ্বংস করে বহু অস্ত্রসহ গোলা-বারুদ উদ্ধার করে ঘাটাইলের হাবিবুর রহমান হাবিব(কমান্ডার) জাহাজ মারা হাবিব হিসেবে কৃতিত্ব অর্জন করেন। সেই যুদ্ধে ঘাটাইলের বীর মুক্তিযোদ্ধা খোরশেদ আলম সহ কয়েকজন আহত হয়। সেখানে কাদেরীয়া বাহিনীর প্রধান বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী (বীর উত্তম), খন্দকার ফজলুর রহমান (সাবেক ব্রিগেডিয়ার) সহ উপস্থিত ছিলেন। টাঙ্গাইলের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দুঃসাহসী ভূমিকায় ড. মাহবুব সাদিক (অব. প্রিন্সিপাল), বুলবুল খান মাহবুব, কবি রফিক আজাদ, মাহবুব মোরশেদ, মাহবুব হাসান, খন্দকার রফিকুল ইসলাম, খন্দাকার বাবুল চৌধুরীর অবদান অত্যন্ত গৌরবোজ্জল। ঘাটাইলের অ্যাডভোকেট আজিজুর রহমান খান দুলাল, সাইদুর রহমান খান মোহন, আব্দুর রশিদ, মোয়াজ্জেম হোসেন খান, হাবিবুর রহমান, হাবিবুল হক খান বেনু, মেনু, আব্দুল বাছেদ মাষ্টার; টাঙ্গাইলের কমান্ডার নবী নেওয়াজ, কমান্ডার লাল্টু, কমান্ডার ফজলুর রহমান ফজলু বীর প্রতীক, আসাদুজ্জামান আরজু, অ্যাডভোকেট আব্দুর রাজ্জাক, আব্দুল আলী, সোহরাব আলী খান আরজু, মনিরুল ইসলাম মনি, বায়েজিদ, শামসুল আলম, এনায়েত করীম, হাবিবুর রহমান খোকা, আবুল কালাম আজাদ, আব্দুস সবুর খান, কালা খোকা; ঘাটাইলের রিয়াজ উদ্দিন, লুৎফর রহমান, লেবু, মতি, খুকু মাষ্টার, বিজন বিএসসি, সেলিম সিদ্দিকী, হারুন সিদ্দিকী, তারেক সিদ্দিকী, আব্দুল জলিল, বাতেন, সুলতান, নূরুল ইসলাম মোক্তার, নজরুল ইসলাম খান, আনন্দ, বাছেদ, আবু তালেব; কালিহাতীর আনিছুর রহমান, আনোয়ার হোসেন, হুমায়ুন বাঙ্গাল, মনির হোসেন মনি, ইব্রাহীম, দুলাল, রশিদ, অ্যাডভোকেট সুবাস, শাহাদৎ, নাসির উদ্দিন, হবিবর রহমান হবি, আজাহার আলী, জিন্নাহ, হুরমুজ, হাকিম তালুকদার; বাসাইলের আব্দুল খালেক খান, জামাল হোসেন (উপ-সচিব); সখিপুরের কমান্ডার গফুর, হাবিব, লোকমান, রফিক; মধুপুরের ড. আব্দুর রাজ্জাক; গোপালপুরের আবু সাইদ খান, আঙ্গুর তালুকদার, হুমায়ুন; ভূয়াপুরের আসাদুজ্জামান আরজু, শামসুল হক তালুকদার, আজিজ বাঙ্গাল, ছানু; টাঙ্গাইল সদরের ইব্রাহীম খলিল, আলমগীর খান মেনু, আব্দুর রউফ খান রোকন, দাউদ, আবু সাঈদ প্রামাণিক (কাতুলী ইউনিয়ন), দেলভর আনসারী, আব্দুর রশিদ লেবু, নুরুল হুদা (তারা), জহুরুল হক, মকবুল, মিনহাজ, রওশন আলী, মো. আব্দুল হামিদ; দেলদুয়ারের জাহাঙ্গীর, আবুল হোসেন প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। নাগরপুরে সাবেক ছাত্রনেতা সাদৎ কলেজের সাবেক ভিপি খন্দকার আব্দুল বাতেনের নেতৃত্বেও গড়ে ওঠে ‘বাতেন বাহিনী’ নামে একটি প্রতিরোধ দল। খন্দকার আব্দুল বাতেন স্বাধীনতার যুদ্ধে অকুতভয় সৈনিক হিসেবে নিজস্ব নেতৃত্বে সৃষ্ট বাতেন বাহনী নাগরপুর, দেলদুয়ার, মির্জাপুর অসীম সাহসী যুদ্ধ পরিচালনা করে মুক্তিযুদ্ধে অনন্য আবদান রাখেন। ওই বাতেন বাহিনীর তারেক খান, সুজাত কমান্ডার, খালেকুজ্জামান খালেক, রিয়াজ উদ্দিন, নুরুল ইসলাম নুরু, কাইয়ুম খান, অ্যাডভোকেট মুলতান, অ্যাডভোকেট দাউদ-এর নাম উল্লেখযোগ্য।
দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর গেরিলা যুদ্ধের নৈপুণ্যে প্রশিক্ষিত পাক হানাদার বাহিনীর কাছে ছিল মূর্তিমান আতঙ্ক। স্বাধীনতাকামী মানুষের অন্তর্নিহিত বাসনা বাস্তবায়নে অনন্য অবদানে সাধারণ জনতা তাকে ‘বাঘা সিদ্দিকী’ উপাধিতে ভূষিত হন। বঙ্গবন্ধু সরকার তাকে একমাত্র বেসরকারি ব্যক্তি হিসেবে সর্বোচ্চ ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাদেক খানের মতে, সমাজে দুর্নীতির পরিস্থিতি শুধু উদ্বেগজনকই নয়, আশঙ্কাজনক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। এ আশঙ্কা আমাদের বিনষ্টের আশঙ্কা। মানুষ এগিয়ে যায়, আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি নৈতিকভাবে।
অনেক বড় বড় প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করছি। মেগা এসব প্রজেক্টগুলোতে দুর্নীতির আশঙ্কায় অর্থ দিতে উৎসাহবোধ করছে না বিদেশি সংস্থাগুলো। দরিদ্র, অসহায় মানুষ যে রিলিফ পায় সেই রিলিফের অর্ধেকটাই চলে যায় দুর্নীতিবাজ এবং চাঁদাবাজদের পকেটে। দুর্নীতি এখন গ্রামের ইউনিয়ন পর্যন্ত চলে গেছে। নগর ও শহর তো নষ্ট হয়েছে আগেই। দেশে যে মেগা প্রজেক্টগুলো হচ্ছে, সেখানে বারবার খরচ বাড়ানো হচ্ছে, কোনো না কোনো অজুহাতে। সাধারণ মানুষের কষ্টে উপার্জিত অর্থ যদি দুর্নীতিবাজদের হাতে চলে যায়, তাহলে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতা বাড়লে অনিয়ম-দুর্নীতি কমে আসবে বলে বলা হলেও আসলে তার কোনো প্রভাব বাস্তবে দেখা যায় না, এটাই বাস্তবতা। দুর্নীতির সঙ্গে বেতনভাতার কোনো সম্পর্ক নেই। যে বেশি বেতন পায়, সে আরও বেশি চায়। চাওয়ার শেষ নেই। কাজেই বেতনভাতা বাড়লে দুর্নীতি কমে যাবে এমন ধারণা যথার্থ নয়। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যপর্যায়ে দুর্নীতি যতটা হচ্ছে তার চেয়ে বেশি হচ্ছে উঁচুপর্যায়ে। আর নিচু পর্যায়েও দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার রয়েছে।
রাজনৈতিক কর্মী যারা, তারা যেভাবে চাঁদা আদায় করে, যে বা যারা ব্যবসাবাণিজ্য করে কিছু লাভ করে, সেখান থেকে ভাগ চায়। জ্বালাতন করে। দুর্নীতির কারণেই শেয়ারবাজারের পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। দুর্নীতিবাজ লোকেরা সরকারের মধ্যে কিংবা আশপাশে রয়েছে।
হাল সময়ে দেশে খুনাখুনিসহ অস্বাভাবিক প্রাণহানির ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে। রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক বিরোধ, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক দ্বন্দ্ব ইত্যাদি কারণে খুন হচ্ছেন নারী-পুরুষ, যুবা-শিশু। নিকটাতœীয়ের হাতে খুনের ঘটনাও ঘটছে বহু। নৃশংস পদ্ধতিতে ঘটানো হচ্ছে এসব হত্যাকা-। প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা, বাসায় ঢুকে গুলি চালিয়ে হত্যা, গলা কেটে হত্যা, ধর্মযাজক হত্যা, বিষ খাইয়ে হত্যা, শ্বাসরোধ করে হত্যা, হত্যা করে লাশ টুকরো টুকরো করে ফেলা ও পুুড়িয়ে মারার মতো অনেক নৃশংসতা ঘটতেও দেখা গেছে। দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসলেও ধর্ষণ, খুন, গুম, নারী ও শিশু নির্যাতন, ঘুষ-দুর্নীতি ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের জোয়ারে সেসব অর্জন ধূলিস্যাৎ হচ্ছে।
পুনশ্চঃ সামাজিক অপরাধ পারিবারিক অপরাধের অন্যতম কারণ হলো আমাদের সমাজজীবনে সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন ক্রমেই শিথিল হয়ে যাওয়া এবং মূল্যবোধের অবক্ষয়। মূল্যবোধের অবক্ষয় ও নৈতিকতার স্খলনের সঙ্গে নানা সামাজিক অপরাধও বিস্তৃত হচ্ছে। এ অবস্থা পরিবর্তনে আইনি প্রচেষ্টা পুরোপুরি টেকসই নয়। পারিবারিক ও সামাজিক বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নিতে হবে। সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্কের বন্ধন শক্তিশালী করতে, মূল্যবোধ জাগ্রত করতে, নৈতিক শিক্ষা জোরদার করতে, সুকুমারবৃত্তির চর্চা উৎসাহিত কর।