টপিকঃ কত শক্তি হাইড্রোজেন বোমায়: শেষ
হাইড্রোজেন বোমায় কত শক্তি তা মাপার আগে শক্তি সম্বন্ধে আমাদের একমত হওয়া দরকার। যদিও পদার্থ বিজ্ঞান সবার চোখের বালি, কিন্তু কি আর করা।
শক্তি কি জিনিস?
শক্তি এমন এক জিনিস যার দ্বারা কাজ করা যায়। যেহেতু কাজের মাধ্যমেই শক্তির প্রকাশ,এস আই ইউনিটে কাজ কাজ আর শক্তির এককও এক! জুল। এখানে শুধু শক্তি না বলে "ব্যায়শক্তি" বা "শক্তি ব্যায়" বললে মনেহয় বাংলা ভাষাগত দিকদিয়ে মানানসই হয়।
এক জুলে কতটুকু শক্তি?
বেশীরভাগ বইয়ে সংজ্ঞাটা এরকম।
এক নিউটন বল দিয়ে, এক কেজি বস্তু, এক মিটার দুরে নিতে যতটুক শক্তি ব্যায় হয় তা হল এ জুল।
সংজ্ঞাটা দেয়া অন্য সকল বলের অনুপুস্থিতিতে। বাস্তব জীবনে যা একটু বিভ্রান্তিকর। কারন আমরা বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে জানি এককেজি একটা বাটখারা, এক মিটার (আড়াই হাত) নিতে ভালই শক্তি লাগে। এক জুল মানে অত শক্তি নয়! কারন বাটখারাটা শুধু আপনিই নাড়ছেন না পৃথিবীও এটাকে তার অভিকর্ষ বল (প্রায় ১০ নিউটন সমান) দিয়ে টানছে! যেহেতু আমরা কেউ মহাশুন্যে থাকিনা। তাই পৃথিবীর বল সাপেক্ষে সংগাটাকে একটু ঘুরানো যায়।
এক নিউটন বল দিয়ে ১০০ গ্রাম একটা বস্তু (যেমন একটা আপেল) মাটি থেকে আড়াই(২.৬৬) হাত উপরে তুলতে যে শক্তি লাগে তা হল একজুল।
(যেহেতু পৃথিবী ১০ নিউটন বলে টানছে, টার্গেট বস্তুর ওজ কমবে ১০ ভাগ)।
ভাবছেন এটা কি হল? শক্তির সংজ্ঞা দেয়া হল বল দিয়ে? বল আর শক্তি তো একই জিনিস। কইয়ের তেলে কই ভাজা নাকি! আসলে তা নয়। বাংলায় শুনতে যাই মনে হোক, শক্তি (Energy) আর বল (force) ভিন্ন জিনিস। একজন বলশালী কিন্তু অলস ব্যাক্তির কথা চিন্তা করুন, যেমন ধরুন যেকোন থানার ওসি। তার পেশীতে যতই বল থাক সারাদিন যেহেতু কিছু করছেননা তার মোট শক্তি শুন্য। শক্তি হল কাজের সমার্থক, বলের নয়।
তাহলে এক নিউটন বল কতটুকু?
এক কেজি বস্তুকে এক মিটার/ বর্গ সেকেন্ড হারে নাড়তে যে পরিমান বল দরকার তাহল এক নিউটন।
মানে এক নিউটন বল দিয়ে কেবল মাত্র একজুল শক্তি বানানো যায়?
না। এক নিউটন বল কতটুকু শক্তি তৈরী করতে পারবে তা নির্ভর করবে বল কতদুর পর্যন্ত প্রয়োগ করা হল। আপনার বাহুতে এক নিউটন বল আছে মানে আপনি এক কেজি বস্তু এক মিটার/বর্গকেন্ড ত্বরনে নাড়তে পারেন। তার মানে এই নয় যে একমিটার গিয়েই আপনাকে থেমে যেতে হবে। আপনি ১০ সেকেন্ড ধরে বল প্রয়োগ করে বস্তুটা ১০ মিটার দুরে নিতে পারেন সে ক্ষেত্রে দশ জুল শক্তি উৎপন্ন/প্রয়োগ হল। দশরথ মাঞ্জির পেশীতে আর দশজনের সমান বলই আছে। কিন্তু সে একাই পাহাড় কেটে রাস্তা বানিয়েছে তার জন্য কতটুক শক্তি দরকার ভাবুন।
এবার আসল কথায় আসা যাক।
মানুষের ঘুসিতে ১০০ থেকে ৫০০ জুল শক্তি থাকে (কঙ্কাল আলী থেকে মোহাম্মদ আলী)।
এক কেজী পানির তাপমাত্রা এক ডিগ্রি সেলিসয়াস বাড়াতে ৪২০০ জুল শক্তি লাগে।
মানে বালতিতে এক কেজি পানি নিয়ে গোটা ত্রিশ ঘুসি মারলে তাপমাত্রা একডিগ্রি বাড়বে?
হয়তো না। শক্তির বিভিন্ন রুপ আছে। ঘুসির শক্তি হল গতিশক্তি আর পানির শক্তি হল তাপশক্তি। গতিশক্তি পুরোটা পানির তাপশক্তিতে রুপান্তর হবেনা। কিছু তাপ বালতিতে যাবে, কিছু বাতাসে যাবে ইত্যাদি। নিচে যখন আমি যখন বিভিন্ন শক্তির পরিমান জুলে দেব, ব্যাপারটা মাথায় রাখতে হবে যে জুলের হিসেবে শক্তি গুলো সমমান হলেও শক্তি গুলো ভিন্ন। কোনটা তাপশক্তি কোনটা গতিশক্তি কোনটা বিদুৎ শক্তি।
আরেকটা বিষয় নিয়ে কথা বলা বাদ গেছে, তা হল TNT. গত পর্বে বললাম হিরোশিমার বোমায় শক্তি ছিল ১৫ কিলোটন টিএনটি। কি এই টিএনটি?
টিএনটি হল ট্রাইনাইট্রোটলুয়েন (C6H2(NO2)3CH3)। এটা এধরনের বিস্ফোরক। অন্যান্য বিস্ফোরকের ধংসাত্বক ক্ষমতা মাপতে টিএনটি দিয়ে প্রকাশ করা হয়। অনেকে টিএনটি আর ডায়নামাইড কে একই জিনিস ভাবে। আসলে তা নয়। ডায়নামাইড হল নাইট্রোগ্লিসারিনের স্টেবল রুপ।
প্রথমেই দেখে ফেলা যাক এক গ্রাম টিএনটিতে কত শক্তি
মানে আধুনিক রাইফেলের গুলির দ্বিগুনেরও বেশী শক্তি এক গ্রাম টিএনটিতে।
মজার ব্যাপার হল কাকতালীয় ভাবে ১ গ্রাম খাদ্য ক্যালরীতেও ১ গ্রাম টিএনটির সমান শক্তি থাকে। একজন মানুষের দৈনিক ২০০০+ কেলরী খাবার লাগে। এর মোট শক্তি ২ কেজী টিএনটির সমমান!!
মান গুলো এতোই ছোটবড় যে গ্রাফে প্রথম দুটোর বার দেখাই যাচ্ছে না। বুঝতেই পারছেন পুরো ব্যাপারটা খুব দ্রুত নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাচ্ছে! মনে মনে বাইশজুয়ান আর তেইশজুয়ানের গল্পটা আওড়াতে থাকুন!
সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার মনেহয় এটাই যে, একটা চকলেট বারের শক্তি একটা চলন্ত গাড়ির গতিশক্তির চেয়েও বেশী! এক কিলোওয়াট ঘন্টা যে নিতান্তই কম শক্তি নয় বোঝাই যাচ্ছে। বিদুৎবিলে কত কিলোওয়াট ঘন্টা আসল এখন থেকে একটু মনোযোগ দিয়ে দেখুন আর কম বিদুৎ খরচ করুন।
অলেম্পিক খেলোয়ার মাইকেল ফিলিপ অলেম্পিক ট্রেনিংএর সময় এক সাধারন মানুষে চারগুন খাদ্যশক্তি ব্যায় করে। পৃথিবীর অভিকর্ষ আকর্ষন ছাড়িয়ে যেতে ১ কেজী বস্তুর শক্তি লাগে ৬৩ মিলিওন জুল। এটা ভাবুন একটা গড় বজ্রপাতে তারচেয়ে ১৭গুন বেশী শক্তি মুক্তি পায়! একটা বজ্রপাতের শক্তি দিয়ে প্রায় ১ টন স্টিল গলিয়ে (১৪০০ মিলিওন জুল) ফেলা যায়।
এই পর্যায়ে এসে বাইশজুয়ান তেইশজুয়ানের গল্পও ফেল! তবে এটা বোঝা যাচ্ছে যে যাত্রীবাহী বোয়িং বিমানের এক টেঙ্ক জেট ফুয়েলে ৬৪শত বজ্রপাতের সমান শক্তি থাকে। বুঝতেই পারছেন ৯/১১ তে বিমান দিয়ে টুইনটাওয়ারে হামলা কেন অত ধংসাত্বক ছিল।
নি:সন্দেহে হিরোশিমার বোমা অনেক শক্তিশালী ছিল কিন্তু এর শক্তি মাত্র এক গ্রাম পদার্থের ভরশক্তিরও সমান না। ভাবছেন মাতাল হয়ে গেলাম কিনা? একটু আগেইনা বললাম এক গ্রাম ইউরেনিয়াম কে নিউক্লিয়ার ফিশান করে ৮৮ বিলিওন জুল পাওয়া যায়। এখন আবার বলছি এক গ্রাম পদার্থ থেকে তার হাজার গুন বেশী শক্তি পাওয়া যায়। হুমম ব্যাপারটা আগের পর্বেই বলেছি যে পারমানবিক বমে পদার্থের ক্ষুদ্র একটা অংশই কেবল শক্তিতে পরিনয় হয়। যেটাকে খুচরা বলেছিলাম। এখন দেখা গেল সেই খুচরা টা হাজার ভাগের একভাগেরও কম!
প্রকৃতির শক্তি এখনো অনেক। একটা বড়সর কালবৈশাখী ঝড়ে নিসৃত সর্বমোট শক্তি হিরোশিমা বোমার দ্বিগুন। তাহলে প্রশ্ন হল কালবৈশাখী ঝড়ে ধংষ এত কম হয় কেন। এর কারন শক্তিটা নিসৃত হয় দীর্ঘসময় ধরে এবং বড় যায়গা জুরে তাই বল অনেক কম। অন্যদিকে এটম বম ফাটে সেকেন্ডের ভংগ্নাংশের মধ্যে তাই বল অত বেশী।
একটা বড়সর ভুমিকম্পে হিরোশিমার হাজার গুন শক্তি নিসৃত হয়। দুনিয়াটা এখনো অনেক বড়। অনেকে বলে মানুষের হাতে থাকা সমস্ত বম দিয়ে দুনিয়াকে ধ্বংষ করে দেয়া যাবে কয়েক বার। যদিও অংকে সেটা বলছেনা। বলা হয় সমস্ত শক্তির আধার সূর্য্য। যথার্থই বলে। সূর্য থেকে ৬মিনিটে যে পরিমান শক্তি পৃথিবীতে আসে তা দিয়ে, পুরো দুনিয়ার সারা বছরের সমস্ত শক্তি চাহিদা (বিদুৎ এবং অন্যান্য) মেটানো যায়!
এই হল এখন পর্যন্ত বিস্ফরিত হওয়া সর্ববৃহৎ হাইড্রোজেন বোমার শক্তি। ২১০ পেতাজুল। বা ২১০ হাজার কালবৈশাখী ঝড়ের মোট শক্তির সমান। রসুলমিয়ার পেশীর সাথে এবার আপনারাই তুলনা করুন।
এতো বড় শক্তিও প্রকৃতির অন্যান্য রাগঘবোলের কাছে কিছুই না। সূর্যথেকে পৃথিবীতে আসা এক সেকেন্ডের শক্তিই এর ছুই ছুই! যদিও সূর্যথেকে নিশৃত শক্তির অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশই পৃথিবীতে আসে। বাকিটা অন্যান্য গ্রহে এবং মহা শুন্যে চলে যায়। কত ক্ষুদ্র? নিশৃত মোট শক্তির মাত্র ০.০০০,০০০,০৪৫ ভাগ পৃথিবী পায়। বলাই হয়নি যে সূর্যে উৎপন্ন মোট শক্তির ক্ষুদ্র অংশই নি:শৃত হয়, বাকিটা সূর্য্য নিজেই খরচ করে অভিকর্ষ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে! তাহলে সুর্য্যে কত শক্তি উৎপন্ন হয়! যদিও মহাবিশ্বের স্কেলে সেই সুর্য্যও কিছুই না!!
পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের আনুমানিক মোট ভর-শক্তি হল 4×10^69 J । মানে চারের পিঠে উনশত্তরটা শুন্য। নাম্বার শুধুই নাম্বার। অনেকেই হয়তো হাই তুলবেন, "ও তাই। এ আর অমন কি!"
সুত্র: Orders of magnitude (energy)