টপিকঃ (অ)সাধারণ মায়ের গল্প।
কথাটা শুনে আমি আরও একবার তাঁর দিকে তাকালাম। শীর্ণ দেহের ভদ্রমহিলা, চেহারার তেমন যত্ন নেন না, বোঝা যাচ্ছে স্পষ্ট। তার উচ্চ শিক্ষিত এবং সুপ্রতিষ্ঠিত সন্তানদের কাছে বিভিন্ন ভুল করেন আর তাদের শাসনে হাসিতে মুখ ভরান। সাধারণ চেহারার সাধারণ মা। অন্তত প্রথম দেখাতে আপনার তাই মনে হবে। উনার মেয়ের কাছ থেকে এই ঘটনা শোনা।
ছোটবেলা থেকেই মেয়ের আঙ্গুল চোষার অভ্যাস। বড় হওয়ার পরও অভ্যাস ছাড়তে পারছে না। মেয়েটি স্কুলে ভর্তি হয়ে গেছে। বাড়ির লোকজন চেষ্টা করে মেয়ের এই বদঅভ্যাস দুর করার। দিনের বেলা চোখে চোখে রাখা সম্ভব হলেও রাতে ঘুমের মধ্যে মেয়েটি মুখে আঙ্গুল দেয় আর সারা রাত এ অবস্থায় থাকে। এভাবেই দিন যাচ্ছিল।
তো একদিন আমাদের এই সাধারণ মা জানতে পারলেন, তার মেয়ের স্কুলের এক শিক্ষিকারও একই রকম রাতে আঙ্গুল চোষার অভ্যাস এবং এখনও তা ছাড়তে পারেননি। এজন্য কখনও কখনও তার স্বামী তার সাথে খারাপ ব্যবহার করেন, কথা শোনান। একথা শোনার পর মা তার মেয়েকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলেন। দিনের বেলা নজরদারি আরও জোরদার করলেন। ফলে দিনে অবস্থা আগের চেয়ে ভাল হল। কিন্তু রাতে যে কাজ সেই। কেউ কেউ পরামর্শ দিল আঙ্গুলে চিরোতার রস লাগিয়ে রাখতে তাহলে তিতকুটে স্বাদের জন্য মেয়ে আর মুখে দিবে না। আঙ্গুলে চিরতার রস লাগিয়েও কোন লাভ হল না।
এদিকে মা-ও হাল ছাড়ার পাত্রী নন। মেয়ের বদঅভ্যাস দুর করার জন্য তিনি রাত জাগার সিদ্ধান্ত নিলেন। সারা রাত মেয়ের মাথার কাছে বসে থাকলেন । মেয়ে যখনই মুখে হাত দেয়, তিনি তা সরিয়ে দেন। বিশাল যৌথ পরিবারের বৌ হিসাবে সারা দিন প্রচন্ড খাটাখাটনির পর এই রাত জাগা। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসে, কিন্তু তাঁকে তো জাগতেই হবে। তিনি ক্লান্ত শরীরে সারা রাত জেগে থাকেন। এভাবে এক দিন গেল, দুই দিন গেল, তিন দিন গেল, এক সপ্তাহ, দুই সপ্তাহ, তিন সপ্তাহ গেল। আস্তে আস্তে মেয়ের বদঅভ্যাস অনেকটা কমে আসলো। পুরো একমাস রাত জাগার পর মা যখন নিশ্চিত হলেন যে মেয়ে পুরোপুরি মুক্ত তখন তিনি থামলেন।
এরকম একটা কথা শোনার পর তাঁর দিকে আর একবার না তাকিয়ে কি পারা যায় বলুন! আমি বুঝতে পারিনা, খুব সাধারণ একটা মেয়ে কিভাবে এমন অসাধারণ মা হতে পারেন। কে জানে হয়ত আল্লাহ প্রতিটি মেয়েকে অসাধারণ মা করেই পৃথিবীতে পাঠান। আর অপর দিকে আমাদের দিকে তাকান, কত সহজেই না আমরা সাধারণের নীচে নেমে যাই। অকৃতজ্ঞতার চুড়ান্ত দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করি তাদের ভুলে গিয়ে, তাদের অবদান কে ভুলে গিয়ে।
[আমাদের সন্তান জন্মের পর থেকেই আমার বৌকে প্রতিদিন দেখছি পরম মমতায় আর কি অসীম ধৈর্যে তাকে বড় করছে। মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে, আমিও তো বাবা, যদি আমাকে মায়ের ভূমিকা নিতে হতো, আমি কি পারতাম এর কাছাকাছি কিছু করতে....। সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে লজ্জা করে। লেখাটা আমার বৌকে উৎসর্গ করছি।]
মুক্ত কর ভয়। আপন মাঝে শক্তি ধর, নিজেরে কর জয়॥"