টপিকঃ নবাবি শহর লখনউ পর্ব # ২
লখনউ স্টেশন মোটামুটি পরিচ্ছন্ন আর হাওড়ার মত অত ভিড়ভাট্টা নেই।
ষ্টেশন এর সামনে অনেক রিকশা আর অটো দাঁড়ানো ছিল আমরা একজনের সাথে কথা বলে ঠিক করলাম যে আমরা কোলকাতা থেকে এসেছি সে আমাদের ভালো হোটেল এ পৌঁছে দেবে।এখানে এরকম ভাবেই পর্যটকরা হোটেল ঠিক করে যদি না আগে থেকেই বুকিং দেয়া থাকে।
লখনৌ মুসলিম প্রধান এলাকা এবং রাস্তায় চলতে গিয়ে বুঝলাম কেন এই শহর কে নওয়াব ওয়াজেদ আলি শাহ এর শহর বলা হয়।
শহরের প্রায় বেশিরভাগ দোকান,শপিংমল বা হোটেল এ নওয়াব ওয়াজেদ আলি শাহ এর প্রতিকৃতি টানানো রয়েছে।
অটো চালক আমাদের নিয়ে এল হোটেল সিমলা প্যালেস এ। মাঝারি মানের বেশ পরিচ্ছন্ন দুই তারকা হোটেল। চেক ইন এর সময় ঘটলো এক মজার ঘটনা ।ম্যানেজার ভেবেছিল আমরা ইন্ডিয়ান আর সে অনুযায়ী রুম ভাড়া ঠিক হয়ে গেল কিন্তু যখন আই কার্ড চাইলো আর আমরা দিলাম পাসপোর্ট বেচারা তো খুব ই অবাক।কেমন ধরা খেল।এ ব্যাপারটা কোলকাতা ছাড়া অন্য জায়গায় প্রায়ই ঘটে আর আমরাও বেশ মজা পাই। কোলকাতায় বাংলা বললেই বুঝে ফেলে আমরা বাংলাদেশি।
চেক ইন করে আমরা গোসল সেরে খাবার অর্ডার করলাম । এখানে, মানে এই হোটেল এ মাছ মাংস পাওয়া যায় না।তাই ভেজ লাঞ্চ করলাম ।মশলা আর পনির এর ব্যাবহার একটু বেশিই মনে হোল তারপর ও খাবারের স্বাদ চমৎকার।
আমাদের হাতে যেহেতু সময় খুব কম তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম সেদিন একটু কেনাকাটা করবো আর আশপাশ টা ঘুরে দেখব। হোটেল থেকে বেরিয়েই গেলাম গৌতমবুদ্ধা মার্গ এ চিকন এর দোকান গুলোতে । লখনৌ বিখ্যাত তার চিকন এর কাজ এর জন্য।
বেশ কয়েকটা দোকান ঘুরলাম।চমৎকার হাতের কাজ।অনেক গুলো দোকান ঘুরে আমরা গেলাম এক ফ্যাক্টরি তে।ওখানে চমৎকার সব পোশাকের বাহার। দোতালায় শো রুম আর নিচে গোডাউন।
অনেক দেহাতী /গ্রাম্য মহিলা কে দেখলাম বস্তা ভরে কাজ করা কাপড় নিয়ে এসেছে।পরে জানলাম এরা সবাই আশেপাশের গ্রামের বউ ঝি। এরা কাপড় নিয়ে যায় ,কাজ শেষ হলে বুঝিয়ে দিয়ে পারিশ্রমিক নিয়ে যায়।
অনেক দোকান ঘুরে কিছু কেনাকাটা করে রাতের খাবার খেয়ে ফিরলাম হোটেল এ।হোটেল গেটে দেখা মিলল সেই অটো ওয়ালার যে কিনা আমাদের ষ্টেশন থেকে নিয়ে এসেছিল।ওর সাথে কথা বলে ঠিক করলাম পরেরদিন সে আমাদের সকাল সন্ধ্যা ঘুরাবে আর সব শেষে স্টেশন এ পৌছে দিবে। পরের দিন সকাল বেলা ব্যাগ প্যাক করে আমরা চেক আউট করলাম আর ব্যাগগুলো রেখে দিলাম হোটেল কতৃপক্ষের জিম্মায়। কারন আমরা ফিরব বিকালে আর সন্ধ্যা বেলায় চলে যাব স্টেশনে। তাই কয়েক ঘন্টার জন্য একদিনের টাকা দেবার কোন মানেই হয় না।
অটো ওয়ালা সকাল সকাল হাজির হোটেলের গেটে। নাস্তা না করেই বের হলাম ।প্রথমেই সে আমাদের নিয়ে গেল এক রেস্তোরায় সেখানে আমরা পরোটা সবজী আর লখনৌ এর বিখ্যাত মিস্টি দিয়ে নাস্তা করলাম।চা খেয়ে আবার অটোতে গিয়ে বসলাম।
আমাদের অটো ড্রাইভার এর নাম পরমিত কাউর, সে পাঞ্জাব থেকে এখানে এসেছে জীবিকার খোঁজে। অক্টোবর এর মাঝামাঝি সময়ে কটকটা রোদ ! অনেক গরম লাগলেও ঘাম হচ্ছিলো না। সমুদ্র থেকে দূরে বলেই আদ্রতা কম। রাস্তাগুলো মোটামুটি পরিচ্ছন্নই বলা যায়। আমরা প্রথমে গেলাম বড় ইমাম বাড়ায়।
প্রবেশ দরওয়াজাটা অনেক বড় । সামনে বাগান । বাগানে নানা রকম গাছপালা । ঘাস দেখে মনে হচ্ছিল সবুজ গালিচা পাতা। বাগানের ওপাশে ইমামবাড়া ।
এখানে প্রচুর দর্শনার্থী ভীড় করে আছে। বিশাল এলাকা জুড়ে এই স্থাপনাটি নির্মাণ করা হয়েছে। ১৭৮৪ সালে নওয়াব আসাফ উদ দউলা এই ইমাম বাড়া টি নির্মাণ করেন। এখানে রয়েছে আসফ উদ দউলা মসজিদ।প্রচুর লোকসমাগম হয় এখানে।অনেকেই এসেছেন অবসর সময় কাটানোর জন্য।
অনেকক্ষণ থেকে তিনটা ছোট ছেলেমেয়ে আমাদের সাথে সাথে ঘুরছিল । ওদের একটা ছবি তুলে দিলাম এবং ওরাও ওদের মোবাইল এ আমাদের ছবি তুলে নিল।ভীষন মজা লাগছিল , যদিও কটকটা গরমে জান পেরেশান ।
এরপর আমরা মসজিদ কে পিছনে রেখে এগিয়ে গেলাম এবং মুল ভবনের ভিতরে প্রবেশ করলাম। কি বিশাল হল রুম!!
একজন গাইড ছিলেন আমাদের সাথে। তিনি সব কিছু বর্ণনা করতে করতে আমাদের ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন ।বিশাল ভবনের ভিতরেই আছে নাওয়াব আসাফ উদ দউলার কবর আর পাগড়ি ।
এখানে অনেকগুলো তাজিয়া আছে যা কিনা মহরম মাসে তাজিয়া মিছিলের সময় বের করা হয়।
এরপর গাইড আমাদের নিয়ে গেলেন উপরতালায়। বিশাল ভবন চক মিলানো দালানের এর এক মাথায় দেয়াশলাই এর কাঠি জ্বালালে অন্য প্রান্তের মানুষের কাছে মনে হয় যেন কেউ কানের কাছে জ্বালালো। গাইড আমাদের কাঠি জ্বালিয়ে শোনালেন আর বললেন এখান থেকেই নাকি সেই প্রবাদের উদ্ভব হয়েছে যে, দিওয়ার ও কো ভি কান হোতা হ্যাঁয় মানে দেয়ালের ও কান আছে।
এত বড় ভবন যেন ভেঙ্গে না যায় সেইজন্য অনেক গুলো দেয়াল তুলে ভার এর ভারসাম্য বজায় রাখতে গিয়ে তৈরি হয়েছে ভুলভুলাইয়া। যেখান থেকে গাইড এর সাহায্য ছাড়া বেরনো প্রায় অসম্ভব।
এই জায়গায় গিয়ে আমার না খালি অক্ষয় কুমার এর কথা মনে পড়ছিল ............
এরপর আমরা উঠে গেলাম ছাদে যদিও প্রখর রোদ তারপরও বাতাস বেশ জোরেই প্রবাহিত হচ্ছিলো আর ভালই লাগছিল।
ওখান থেকে শহরের চমৎকার একটা দৃশ্য দেখা যায়।পাশ দিয়ে বয়ে চলা গোমতি নদীটিও দেখা যাচ্ছিলো। দূর থেকে পুরো শহরটাকেই দারুন লাগছিলো ।