টপিকঃ শ্যাম রাজার দেশে ( সপ্তম পর্ব )
ছবিরমতো সুন্দর শহর হুয়াহিন আর প্রানবুরি ম্যানগ্রোভ বন
সকাল বেলা নাস্তা সেরে রওনা দিলাম বাস স্টপেজের দিকে । এবারের গন্তব্য হুয়াহিন । ওদের বাস স্টপেজ একদম ঝকঝকে তকতকে অনেকটা আমাদের ডমিস্টিক এয়ার পোর্টের মত । বাসে উঠার আগে একগাদা ফল কিনে নিলাম ,ওদের পেয়ারা আর আম গুলা আমার দারুন লাগছিল । পেয়ারা দেখে মনে হচ্ছিল পাকা তুলতুলে কিন্তু খাওয়ার সময় বুঝলাম একদম কচকচা আর মিষ্টি। আমের দশা আবার অন্যরকম কাঁচা কিন্তু দারুন মিষ্টি ।
প্রতিদিন কয়েক ঘন্টা পর পর বাস ছাড়ে হুয়াহিন এর উদ্দেশে। বাসে করে ব্যাংকক থেকে হুয়াহিন আসতে সময় লাগে তিন/সাড়ে তিন ঘন্টা। আগে থেকে আমাদের হোটেল ঠিক করা ছিল না।বাস স্টপেজ এ নামতেই একলোক এসে জিজ্ঞেস করলেন কই যাব ? হোটেল বুকিং করা আছে কি না?আমরা যখন বললাম যে আমরা বিচ এর কাছে ভাল মানের গেস্ট হাউজ খুঁজছি তখন সে আমাদের বলল যে উনি আমাদের নিয়ে যেতে পারেন যদি আমরা চাই।এ বিষয়ে আমি আগেই শুনে এসেছিলাম তাই নির্দ্বিধায় উঠে বসলাম ঘোড়ার গাড়িতে । শহরের রাস্তাঘাট গুলো অনেক পরিছন্ন আর মানুষজন ও অনেক কম।ঝকঝকে রোদেলা এক দিন।
গালফ অফ থাই এর তীরে থাইল্যান্ড এর অপরূপ সুন্দর শহর হুয়াহিন। ব্যাংকক বা পাতায়ার মত এখানে অতটা ভীর নেই।শান্ত নিরিবিলি।মালায় পেনিন্সুলার উত্তারাংশে এটা থাইল্যান্ডের বিখ্যাত বিচ রিসোর্ট। বেড়ানোর জন্য, নিরিবিলি কিছুটা সময় নিজের মত করে কাটানোর জন্য আদর্শ জায়গা।
পুরো শহরটাই অদ্ভুত রকমের শান্ত।মনে হয় কারও কোন তাড়া নেই। দশ মিনিটেই পৌছালাম হোটেল নিলাওয়ান এ।
হোটেল আমাদের বেশ পছন্দ হল।ছিমছাম আর পরিছন্ন।একটু ফ্রেশ হয়ে বের হলাম সি বিচ এ। হোটেল থেকে মাত্র ৩/৪ মিনিত হাঁটলেই সাগর। এত শান্ত আর সুন্দর আবহাওয়া যা কিনা অকারনেই মনকে ভাল করে দেয়।
সি বিচ এ খুব বেশি লোকজন নেই।শুয়ে বসে অলস সময় কাটাচ্ছে কিছু লোক আর এক জার্মান
পরিবার সাগরের পানিতে হুটোপুটি করছিল। অনেকক্ষণ সাগরের রূপ মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। পানির রঙ আমার কাছে সবুজাভ মনে হচ্ছিল।হঠাত আমার সঙ্গিসাথিদের ইচ্ছা হোল তারা বানানা বোট এ চড়বে। আমাকে কিছুতেই রাজি করাতে না পেরে তিন পণ্ডিত গেল রাইড এ।
ঃ প্রিয়াম,কেয়াপু ও সফেন বানানা বোট এ ঃ
স্পিড বোট চালক সামনে আর পিছনে ওরা তিন জন।আমি ক্যামেরা নিয়ে রেডি। ওমা!! কিছুদুর যাওয়ার পর দেখি ওরা হাওয়া হয়ে গেছে।ভয়ে আতংকে আমি হতভম্ব। বোট উলটে সাগর তলায়।কিন্তু লাইফ জ্যাকেট এর বদৌলতে ভুস করে ভেসে উঠেছে আর দাঁত বের করে হাসতে হাসতে অর্ধেক পথে তীরে ফেরত এসেছে। তবে ভয় তারাও পেয়েছে । আরও কিছুখন সময় সৈকত এ কাটিয়ে হোটেল এ ফেরার পথ ধরলাম। এখানে প্রতিটি বাড়ি, গেস্ট হাউস আর হোটেল এর বাইরে পানির কল আছে যাতে বালু মাখা গায়ে কেউ রাস্তা বা হোটেল এর রুম নোংরা না করে। যথাসম্ভব নিজেদের পরিস্কার করে আমরা হোটেল এ ফিরলাম।
গোসল সেরে লাঞ্চ এর জন্য নিচে নেমে দেখি যে মেয়েটা সাধারনত খাবার পরিবেশন করে সে পরম যত্নে এক কুকুরের হাত পায়ের নখের পরিচর্যা (ম্যানিকিওর আর প্যাডিকিওর) করছে। ওই দৃশ্য দেখে সেখানে আর খাওয়ার রুচি হল না। আমরা বের হয়ে কাছেই আর এক হোটেল এ গেলাম খেতে। খো খো মানে ভাত আর চিকেন এর দুই পদ একটা কচি বাশ আর এক পদ মিসটি তুলসী দিয়ে রান্না করা খাবার পেট পুরে খেলাম।
খাওয়া শেষে অল্প বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পরলাম শহর দেখতে।
প্রথমেই গেলাম হুয়াহিন এর ওয়াট হুয়ায় মংকল এ । বিশাল বিশাল দন্ত বিকশিত করে দাঁড়িয়ে আছে পবিত্র হাতি মহাশয় । অনেক পর্যটক কে দেখলাম মজা করে হাতির দাঁত ধরে ছবি তুলছে ।
সাধারণত লর্ড বুদ্ধা আর তার তার অনুসারী মঙ্ক দের বেশ নাদুস নুদুস মূর্তি দেখা গেলেও এখানকার মঙ্ক বেশ শীর্ণ কায়া ।
বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে বেড়িয়ে এলাম ,এবার যাব টুকটাক কেনাকাটা করতে । থাইল্যান্ড এর সব শহরেই নাইট মার্কেট আছে ।আবার তখন হুয়াহিন এ কিসের যেন মেলাও
হচ্ছিল। কেনাকাটা আর খাওয়া শেষ করে হোটেল এ ফিরেই ঘুম কারন পরের দিন যেতে হবে প্রানবুড়ি তে।
ঘুম থেকে আমরা ঝটপট রেডি হয়ে ব্যাগ নিয়ে নিচে নেমে এলাম। কারন প্রান বুরি থেকে ফিরে আমারা সোজা চলে যাব ব্যাংকক । নাস্তা খেয়ে হোটেল এর সবাইকে বাই বলে বেরিয়ে পরলাম।আগে থেকে ঠিক করে জিপ অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য। হুয়াহিন থেকে প্রানবুড়ি জিপ এ মাত্র ২০ মিনিটের ড্রাইভ।
রাস্তার পাশে ব্ল্যাক মাউন্টেন কে পিছনে ফেলে আমরা থামলাম প্রানবুড়ি ম্যানগ্রোভ বনের ধারে। রাস্তা গুলো ঝা চকচকে মসৃণ । যেখানে এসে গাড়ি থামল সেই জায়গা দেখে তো আমি অবাক । এত্ত সুন্দর শান্ত নিরিবিলি ।
ডান দিকে প্রানবুড়ি নদীর তীরে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট আর বাঁদিকে ঝাউবন আর তারপরেই নিল সাগর। প্রকৃতির উজার করা মোহময়ী সৌন্দর্য ।
প্রবেশ পথের কাছেই আছে কাঁকড়ার ভাস্কর্য। এখানে এই কাঁকড়া প্রচুর পরিমানে পাওয়া যায় । আমরা বনের ভিতর প্রবেশ করলাম ।বনের ভিতর ন্যাচার ট্রেইল বা কাঠের রাস্তা ধরে অনেক দূর পর্যন্ত হেঁটে যাওয়া যায়।আমরা ধীরে ধীরে বনের ভিতর হেঁটে যেতে শুরু করলাম । কটেকটে রোদ আর পরিষ্কার আকাশ । পোকামাকড়ের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছিল না । চারপাশের গাছগুলো শ্বাসমূল বের করে আছে। এটাই তো ম্যানগ্রোভ বনের বৈশিষ্ট্য । দেখতে তাই অনেকটা আমাদের সুন্দরবনের মত লাগছিল ।
আমার ভাইজান যথারীতি কাঠের রাস্তা ছেড়ে গরান বনভূমির গাছের মুলে দাড়িয়ে খানিকক্ষণ লম্ফ ঝম্ফ করল। ওঁর সাথে যোগদান করলো সফেন । কি আর করা !! লাফালাফি শেষ হলে আমরা আবার হাঁটা শুরু করলাম ।
বনের ভিতর কাঠের রাস্তা ধরে অনেক দূর পর্যন্ত হেঁটে যাওয়া যায়। চারপাশের গাছগুলো শ্বাসমূল বের করে আছে।
হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গেলে একটু বসে গল্প করার ও জায়গা আছে।হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গেলে একটু বসে গল্প করার ও জায়গা আছে।আমরাও কিছুক্ষণ বসে বিশ্রাম নিলাম । বাতাসে গা জুড়িয়ে যায় । আমার তো দুচোখ ভেঙ্গে ঘুম চলে আসছিল ।তাই তাড়াতাড়ি উঠে আবার হনটন আরম্ভ করলাম ।
হাঁটতে হাঁটতে ভিতরে চলে গেলাম ওয়াচ টাওয়ার এর কাছে । টাওয়ার এ উঠে দেখি আরও কয়েকজন এর একটা দল বনের ভিতরে আসছে ।
চারপাশে সুনসান নিরবতা আর পাখিদের কিচিরমিচির ছাড়া কিছুই শোনা যায় না। নিচে নেমে এসে দেখি প্রানবুড়ি নদীর রেখা ।
জোয়ারের পানি তখন ছিল না তাই কিছু জলচর পাখি বনের মাঝে প্রবাহিত প্রানবুড়ি নদীতে মনের আনন্দে হেটে বেরাচ্ছিল। ক্যামেরার ক্লিক শব্দেই সব উড়ে পালাল।
বনের মাঝ থেকে নাম না জানা ফুলের মিষ্টি ঘ্রান আর কেমন যেন একটা বুনো গন্ধ ভেসে আসছিল।এখানে দেখলাম প্রচুর পরিমানে কাঁকড়া । গাছের শিকড়ে ,কাদা পানিতে কিলবিল করছে ।
অনেক দূর হেঁটে গেলাম আমরা । পাখিদের কিচিরমিচির আর বনের বুনো গন্ধ ছাড়াও কেমন যেন একটা মিস্টি ঘ্রান ভেসে আসছিল ।একটু এগোতেই বুঝলাম ঘ্রানের উৎস ।থোকা থোকা সাদা ফুল থেকে আসছে এমন মাতাল করা ঘ্রান ।
অনেক্ষন পর আমরা বন থেকে বেরিয়েএলাম। যেহেতু এটা ন্যাচারাল ম্যানগ্রোভ পার্ক তাই নিশ্চিন্তে নিজেরাই ঘুরে আসা যায় গাইড এর সাহায্য ছাড়া।পাখি, পোকামাকর আর কাঁকড়া ছাড়া হিংস্র প্রানি কাছে আসার সুযোগ নাই। কারন যেহেতু এটা ফরেস্ট পার্ক তাই কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা।তবে ওয়াচ টাওয়ার এ না উঠে দেখলে বোঝার উপায় নাই যে এটা তার দিয়ে ঘেরাও করা।
বন থেকে বেরিয়ে সামনে রাস্তা আর তারপরেই ঝাউবন।ঝাউবনের পর অবারিত নিল সাগর।
এখানে ঝাউবনের মাঝে একটা ছোট রেস্তোরাঁ আছে।সেখানে বসে পানি আর হাল্কা খাবার খেয়ে নিলাম । ওখানে বসে আমার মনে হচ্ছিল আমার একদিকে কক্সবাজার আর একদিকে সুন্দরবন।
এরপর আবার আমরা যাত্রা করলাম হুয়াহিন এর দিকে। ইচ্ছে ছিল ট্রেন এ চড়ে ব্যাংকক যাবো।
হুয়াহিন এর রেলওয়ে ষ্টেশন এক দেখার জায়গা বটে ।
অনেক চমৎকার স্থাপত্য শৈলী যে কাউকে মুগ্ধ করবে। কিন্তু রেল এর টিকেট না পেয়ে মিনিবাস এ করে ফিরলাম ব্যাংকক। মিনিবাস এ সময় আরও কম লাগে। তিন ঘণ্টাতেই পৌঁছে গেলাম।
(আগামী পর্বে সমাপ্য )