টপিকঃ ছোট্ট জীবনে ভ্রমণ করা স্থানগুলো (পর্ব-৫)
রাত ১১ টা। কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে বাস ছেড়েছে।সব মিলে আমাদের ৩০ জনের মত টিম।সবাই বাসে উঠে গেছে। বাসে নাইট জার্নি করার একটা আলাদা মজা আছে। প্রকৃতি হয়তো কালো অন্ধকারে ঢাকা পড়ে, কিন্তু মহাসড়ক জুড়ে লাল, নীল,সবুজ, হলুদ আলো গুলোর ঝলকানি চকমক করতে থাকে।যথাসময়ে বাস ছাড়ার পর ইয়ারফোন কানে গান শুনতে শুনতে পেরোচ্ছিলাম রাস্তা। আধো ঘুম, আধো জাগরণে পথ চলতে চলতে আসলাম চট্টগ্রামের পথে।ভোর হতে শুরু করেছে।
রাস্তার উপর দিয়েই গাড়ি চলছে না পাহাড়ের উপর দিয়েই চলছে কেমন যেন ঠাহর করতে পারছিলাম না। রাস্তার এক একটা বাঁক যেন মনে হয় ১৬০-১৭০ ডিগ্রি করে হবে আর নিচু থেকে উঁচু তো একটু পরই ছলাৎ করে উঁচু থেকে নিচে নেমে যায়।ঠিক যেন ছোট্ট ছোট্ট রোলার কোস্টারের সমাহার।
রেস্ট হাউজ আগে থেকেই বুক করা ছিল। তার নিচতলাতেই ছিল রেস্তোঁরা। এলাকার পরতে পরতে রেস্তোঁরা থাকলেও পৌষী নামে সম্ভবত একটা নামকরা রেস্তোঁরা আছে।আমি তেমন কোনো পার্থক্য দেখলাম না স্বাদে। সবগুলো রেস্টুরেন্ট এর খাবার দাবার ই যথেষ্ট সুস্বাদু।সকালের খাবার খেয়ে ইজি বাইক করে উঠে গেলাম ভাগ ভাগ হয়ে। গন্তব্য লাবণী পয়েন্ট। ১৫টি পয়েন্ট আছে পুরো বিচের। ২য় পয়েন্টটি লাবণী পয়েন্ট এবং সবচেয়ে বড় পয়েন্ট এটিই।
সমুদ্রের ঢেউ অনুভব করা এক অন্যরকম অনুভূতি।বলে ঠিক বোঝানো যাবেনা। ঢেউগুলো এমন সুন্দর কলকল ধ্বনি তুলে এগিয়ে আসে আর একেকটা ঢেউ গড়িয়ে এক একটা জায়গায় এসে ঠেকে, পা ছুঁইয়ে গেলে এক অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করে। পৃথিবীটাকে এরকম সুন্দর ভাবতেই ইচ্ছে করে তখন। মাথায় আর কোনো কিছু থাকেনা।এর আগে অবশ্য আপনাকে তপ্ত বালুর উপর পা মাড়িয়ে আসতে হবে। আবহাওয়া দেখে অবাক হয়ে গেলাম।শীতকাল চলছিল।তবে কক্সবাজারে তার লেশমাত্রই নেই।
পৌষী থেকে দুপুরের খাবার সেরে চলে গেলাম দুপুরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। আমার আগে যারা এখানে আগে এসেছিলেন সফরসঙ্গীদের মধ্যে তারা বললেন বিচে আগে অনেক কাঁকড়া,জেলিফিস, শামুক, ঝিনুকদের দেখা মিলত। এখন কিছু মরা ঝিনুক ছাড়া তেমন কিছুরই দেখা মেলে না। অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যে দেখা মিললো শুধু একটা জেলিফিসের।এ ব্যাপারটি কষ্টদায়ক।মূলত নদীদূষণের কুপ্রভাবে এই মূল্যবান পর্যটন আকর্ষণটিরও আজ এ অবস্থা।
দুপুর থেকে অপেক্ষার উদ্দেশ্য ছিল সূর্যাস্ত উপভোগ করা। সে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা।সূর্যটা একটু একটু করে নিচে নামে, আকাশে স্তরে স্তরে কমলা রংটা হাল্কা হয়, আর পানির রংটা গাঢ় কমলা হয়ে যায়। জীবন্ত এ দৃশ্য মনে স্নিগ্ধতার ঢেউ খেলবেই।
সন্ধ্যার নাস্তাটা সেরেই বের হলাম বার্মিজ মার্কেটে। হরেক রকম আচার, অলঙ্কার আর অর্নামেন্টারি জিনিসের সমাহার।কিছু ঝিনুকের মালা, শঙ্খ আর আচার কেনা হলো অনেক রকম।নিয়ে এলাম অনেকগুলো। খুশি লাগলো আত্মীয় স্বজনদের সাথে ভাগাভাগি করব বলে।
পরদিন সকালবেলা তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে, সকালের খাওয়া সেরে বেরিয়ে পরলাম হিমছড়ির উদ্দেশ্যে। ইজি বাইক ছটা ভাড়া করে সবাই মিলে যাচ্ছিলাম।যাবার পথে রাস্তার দু ধারে তাকিয়ে আপনার সৌন্দর্য উপভোগের খায়েশ মিটবে অনেকটা। বুঝতে পারবেন পাহাড়িদের জীবনাচরণও। ছোট ছোট বাচ্চা মেয়েগুলোকে দেখলাম কলা পেরে খাচ্ছে।ছোট্ট ছোট্ট ঘরগুলো।বাইকে থেকেই এগুলো আপনার চোখে পড়বে।
পৌঁছে গেলাম হিমছড়ি। অনেকটা পার্কের মত করা হয়েছে জায়গাটা।মোটামুটি ভাল উঁচুতে পাহাড় আছে একটা।উঠবার জন্য সিঁড়ির ব্যবস্থাও করা হয়েছে।জায়গায় জায়গায় আছে ছোট ছোট মার্কেট।মূল আকর্ষণ ঝর্ণা।আশ্চর্যের মত তার বুক চিরে পানি পরছে অবিরত।
যে জিনিসটি মিস করা একদমই যাবেনা, তা হল ডাবের পানি। কক্সবাজারে হিমছড়ি হোক আর যেখানেই পান না কেন পুরো জেলায়,ডাব খেতে মিস করা চলবেনা। এত মিষ্টি ডাব বাংলাদেশের
আর কোথাও খেতে পাবেননা।
কক্সবাজারে এসছি।বসে কি কাটানো যায়! বিকেলে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত হল বিকেলে বৌদ্ধমঠ পরিদর্শনে যাব। সেখানে একটি মন্দিরে গেলাম। খালিপায়ে ভেতরে প্রবেশ করে দেখে এলাম কয়েক শত বছর আগেকার মূর্তি,স্মৃতিচিহ্ন। মেঝেটি কাঠ দ্বারা নির্মিত।সাথেই একটি বিশাল মঠ।ছবি তুললাম,ঘুরলাম।বিকেলটা বেশ কেটে গেল।
সন্ধ্যায় নাস্তা করে বার্মিজ মার্কেটের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে জানতে পারি সেদিন পূর্ণিমা। শুনেই গন্তব্য লাবণী পয়েন্ট।পূর্ণিমা রাতের জোয়ার আর জোৎস্নাবিলাসের লোভ আর সামলাতে পারলাম না।
ব্যস্ত সফরের শেষ দিন। খুব ভোরে খেয়ে দেয়ে আর নেয়ে চলে গেলাম ইনানী বিচের উদ্দেশ্যে।শুভ্র নীলাকাশের সাথে কালো পাথরে মোড়ানো বিচ।পাথরের তেমন দেখা অবশ্য পেলাম না।কারণ গত রাতের পূর্ণিমার জোয়ারে পানি বেড়ে গিয়েছে।একটা নান্দনিক ব্রিজ আছে।তার উপর উঠে পায়চারি করলাম।ভালোই লাগল।দেড় ঘন্টার মধ্যে ফিরে এলাম ইনানীর তরতাজা স্মৃতি নিয়ে।তবে ফেরার আগে একটা করে ডাব তো হতেই পারে!!
গন্তব্যের শেষ ঠিকানা। সকাল ৯টায় আমাদের সিপ। এম ভি বাঙালী। নাফ নদীর উপর দিয়ে সিপ যখন যাচ্ছে,চারদিকটাকে স্বর্গ মনে হচ্ছে। একেবারে বাংলাদেশের শেষ প্রান্ত টেকনাফে এসে পৌঁছেছি। গরম গরম এক কাপ কফি খেতে খেতে জানালার পাশে বসে নদীর ওপাশ থেকে পাহাড় দেখছিলাম।কিছুদূর পাড়ি দিতেই দেখি সীগালের সারি উড়ে উড়ে চলে যাচ্ছে।তখন প্রকৃতির অমোঘ সৌন্দর্য সবাইকেই ফটোগ্রাফার বানিয়ে ফেলে।আপনার হাতছোঁয়া দূরত্বেই দেখতে পাবেন মোহনীয় এ দৃশ্য।
সিপের ছাদে উঠা হল কয়েকবার। চার ঘন্টার কিছু সময় বেশি রেগে পৌঁছালাম নারিকেল জিঞ্জিরা খ্যাত সেন্ট মার্টিনে।কর্তব্য খেয়ে নেয়া।ভোর পাঁচটায় নাস্তা করেছি।বিকেল ৩টা বেজে গেছে।লাঞ্চ করেই টেম্পো করে উঠে গেলাম সেন্টমার্টিন্সের উদ্দেশ্যে।২০ হাত দূর থেকেই অবাক চোখে চেয়ে রইলাম।এ কোথায় এলাম। আসলে কক্সবাজারের চেয়েও ঢের অপূর্ব এই বাংলাদেশের একমাত্র এ প্রবাল দ্বীপ।
চারদিকে সারি সারি নারিকেল গাছ।পানির ভেতরটা দেখা যাচ্ছে এত্ত স্বচ্ছ পানি।নীলনদ দেখিনি আমি,কিন্তু সেন্টমার্টিন্স দেখেছি বললে আত্মতৃপ্তি হবে। প্রবাল নাকি একটি প্রাণী!আমি ভেবেছি পাথর।কিন্তু না। প্রাণীগুলো যুগে যুগে সূর্যের তাপে এমন জীবাশ্মে পরিণত হয়েছে। সবুজ সবুজ শেওলা এর আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে তুলেছে।তবে সাবধান! বেশি সামনে গিয়ে ঢেউ উপভোগ করা মানা সেন্টমার্টিন্সে।কেননা, চোরাবালির উপস্থিতি লক্ষণীয়।পুরো দ্বীপটা ঘুরে কাটালাম জীবনের অন্যতম সেরা তিনটি ঘন্টা সময়।
যাবার বেলা নারিকেল জিঞ্জিরার "ডাব" তথা green coconut না খেলে কি চলে! ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। ঘুমে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।ক্লান্ত একটা রাত।যাবার বেলা হয়ে এল বলে।তল্পিতল্পা গোটানো হচ্ছে।সংক্ষিপ্ত একটা ঘুম।সকালের নাস্তা।গেস্ট হাউজে শেষ ক্লিক স্মৃতিবাক্সে ধরে রাখতে। বাসে উঠলাম।গন্তব্য নিজ নীড়ে কিন্তু কেন যেন মনে হয় তা দূর,বহুদূর।