টপিকঃ গহীন বান্দরবান: পর্ব-১৪
পর্ব-১৪ঃ ব্যানানা এফেক্ট
হরিচন্দ্র পাড়ায় আমরা অনেক কলা খেয়েছিলাম, প্রচন্ড মিষ্টি কলা। অনেকক্ষণ হাঁটার কারনে এত ক্ষুধা লেগেছিল যে, সেই ক্ষুধার ঝড়টা কলার উপর দিয়েই গেছে। একটা ঘরের মাচার উপর গাছের ছায়ার নিচে বসে মনের আনন্দে বিশ্রাম নিতে নিতে কলা খাওয়া – একটু ভেবে দেখুন তো কেমন ছিল সময় টা...।
একটুখানি বিশ্রাম আর কলা ভক্ষণ
পাড়া থেকে নেমে কিছুক্ষণ হাঁটার পর আমরা পদ্ম পাড়ের ঝিরিতে পৌঁছে গেলাম। এবার এ পথ ধরে সামনে এগুলেই পদ্মার পাড়। কতক্ষণ লাগবে এই কথা আর গাইডকে আর জিজ্ঞাসা করলাম না, যতক্ষণই লাগুক, পৌঁছাতে তো আমাদের হবেই।
এই ঝিরি দিয়ে হাঁটার অভিজ্ঞতা সম্পুর্ন নতুন। সারা রাস্তা দিয়ে পানি বয়ে যাচ্ছে আর আমরা পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, কোথাও গুঁড়া পাথর কোথাও বড় বড় পাথর। জোঁকের ভয় আমাদের ভালই ধরেছে, কিছুক্ষন পরপরই সবকিছু পরীক্ষা করছিলাম জোঁকে ধরেছে কিনা। সাইফুল ভাইকে ইতিমধ্যেই জোঁকে কেটেছে, সাথে গাইড দুইজনকেও। আমি শুধু বাকি আছি। ঠুসাই পাড়া থেকে আসা দুইজন অনেক আগেই আমাদের পার হয়ে গেছে।
হরিচন্দ্র পাড়া পার হবার পরও প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে হাটঁছি, হঠাৎ করে পেটটা মোচড় দিয়ে উঠলো। গোগ্রাসে কলা খাবার ফল টের পাচ্ছি। গাইডকে জিজ্ঞাসা করলাম আশেপাশে কোন পাড়ায় কিছুক্ষণ থামা যাবে কিনা, গাইড জিজ্ঞেস করলো কেন? বললাম পেট ব্যাথা, একবার পেটটা খালি করতে পারলে একটু শান্তি পেতাম। গাইড আমার কথা শুনে হেসে দিল, এখানে পাড়ায় থামলেও পেট খালি করার সুব্যবস্থা ঠুসাই পাড়ার মত পাওয়া যাবেনা।
অবশেষে আর কি করা, ভেবেছিলাম এবারের বান্দরবান যাত্রায় হয়তো এ অভিজ্ঞতা নেয়া লাগবে না, কিন্তু বিধিবাম। প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে “ভোগে সুখ নাই, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ” কথাটাকে যথার্থ প্রমান করার অভিজ্ঞতাটা নিয়েই ফেললাম। সে কি শান্তি। আরো কিছুক্ষণ হাঁটার পর আমাদের দলের আরো একজনকেও একই অভিজ্ঞতা নিতে হলো – ব্যানানা এফেক্ট আর কি!
আমরা হেঁটেই চলছি। ঝিরির চারপাশে এত রংবেরঙ্গের গাছ, কত নাম না জানা ফুল ফুটে আছে, মনে হচ্ছিল আমি ন্যাশনাল জিওগ্রাফির কোন অনুষ্ঠানের হোস্ট হিসেবে কাজ করছি। ঝিরির কোথাও কোথাও আবার কোমর সমান পানি। কোনরকম ব্যাগ মাথার উপর নিয়ে সেইসব রাস্তা পার হয়ে গেছি, আবার মাঝে মাঝে পাহাড়ের গা বেয়ে পানি পড়ছে ঝর্নার মত, রাস্তায় হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল সত্যি কিন্তু পুরোটা সময় যেন স্বপ্নের মত পার করছি। এত অল্প সময়ের মাঝে এত বিচিত্র কিছু চোখে পড়ছে যে কোনটা রেখে কোনটা মনে রাখবো খেই হারিয়ে ফেলছিলাম। রাস্তায় পানির আধিক্য থাকায় মোবাইল ব্যাগের মধ্যে ভরা ছিল যাতে পানি ভেতরে না ঢুকে তাই এ রাস্তায় খুব একটা ছবি তোলা হয়নি।
ঝিরি দিয়ে চলার এক মুহুর্ত
স্মৃতিগুলো ক্যামেরায় বন্দি না করতে পারায় এখন আফসোস হচ্ছে। মাঝে খোলা মাঠ ছিল যেখানে আমরা শুয়ে বসে বিশ্রাম নিয়েছিলাম, আর জোঁক পরীক্ষাতো অঘোষিতভাবে কিছুক্ষণ পরপরই চলছিল। আমার পায়ের আংগুলের মাঝে জোঁকের মত কি জানি লাগছিল কিন্তু রক্ত খাবার আগে আমি সেটা ফেলে দিয়েছিলাম। নওশাদ আর সাইফুল ভাই বললো ওটা জোঁক ছিলনা, আর যেহেতু রক্ত ঝরেনি তাই আমি নিজেও সিওর না। পুরো রাস্তায় আমি একমাত্র ব্যাক্তি যাকে জোঁক ধরতে পারিনি অথচ অনেকখানি রাস্তা আমি খালি পায়ে হেঁটে এসেছিলাম।
খোলা ময়দানে চলছে বিশ্রাম আর জোঁক পরীক্ষা
অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে অবশেষে আমরা পদ্মার পাড়ে পৌঁছালাম। ভোরে যখন রওনা দিয়েছিলাম তখন ঘড়িতে ছয়টা বেজেছিল আর এখন ঘড়িতে বাজে প্রায় বারোটা। আমরা গত ছয় ঘন্টা ধরে হাঁটছি। ছ...য়... ঘন্টা। এই দুই দিনের পরিশ্রমে শরীরের হাড় মাংস সব খুলে মনে হয় আবার জোড়া লেগে গেছে। ঠুসাই পাড়া থেকে আসা লোকজন আমাদের জন্য পদ্মার পাড়ে অপেক্ষা করছিল। একটা ইঞ্জিনের নৌকাও রেডি ছিল। পাড়ে একটা দোকান ছিল, আমরা সবাই মিলে কিছু খেয়ে নিয়ে রওনা দিলাম থানচির উদ্দ্যেশ্যে।
পদ্মার পাড়
আকাশে তখন মেঘগুলো নানান আকারে সেজেছিল। চারপাশে পাহাড় আর গাছপালা, উপরে নীল আকাশ সাথে তুলার মত ভেসে থাকা মেঘ, সময়টা দারুন কাটছিল। এতক্ষন ধরে হেঁটে আসার কথা বারবার মনে করছিলাম, শারীরিক সব কষ্ট ভুলে এখন শুধু ভালো স্মৃতিগুলোই মনে পড়ছে।
নানান সাজে মেঘ
নৌকার সবচাইতে কনিষ্ঠ যাত্রী
নীল আকাশ সাথে নানান রঙের মেঘ
নীল আকাশ সাথে নানান রঙের মেঘ
চলবে... (আগামী পর্বই শেষ পর্ব)