টপিকঃ গহীন বান্দরবান: পর্ব-১৩
পর্ব -১৩ঃ শেষ এডভেঞ্চার
পরেরদিন আমরা আবারো ভোরবেলা উঠে গেলাম। বাইরে তখনো ঘন কুয়াশা। গাইড আজকেও সকালে উঠে খাবার রেডি করে রেখেছে। একই জিনিস কয়েকবেলা ধরে খেতে ভালো লাগছিল না, তাও অল্প কিছু খেয়ে উঠলাম। আমাদের রান্নার যেসব জিনিসপত্র অবশিষ্ট ছিল সেগুলো ওদেরকে রেখে দিতে বললাম। পাহাড়ি এলাকায় ডিম একদমই পাওয়া যায়না, তাই আমাদের কাছ থেকে ডিমগুলো পেয়ে ঘরের লোকজন মারাত্মক রকমের খুশি হয়েছিল। এমনকি ডিমগুলোর জন্য বাড়তি দামও দিতে চেয়েছিল। আমরা সবই রেখে আসলাম।
আর দুইরাত থাকার জন্য এখানেও জনপ্রতি দুইশো টাকা দিতে হলো। বাকি চাল, সবজি আর রান্নার জন্য সবমিলিয়ে ১২০০ টাকার মত লেগেছিল। ১২০০ টাকা আমাদের জন্য কিছু না হলেও ওই বাড়ীর লোকদের কাছে অনেক কিছু, টাকাটা হাতে পাবার পর মুখের হাসি দেখেই তাদের আনন্দ বুঝে গিয়েছিলাম। যাইহোক, আমরা রওনা দিলাম, তখন প্রায় ঘড়িতে ছয়টা বাজে, চারিদিকে তখনও বেশ কুয়াশা (নাকি মেঘ?)
ভোরবেলায় ঠুসাই পাড়া; ফটো ক্রেডিটঃ সাইফুল ভাই
আমরা ভেবেছিলাম, বান্দরবান ভ্রমন আমাদের এডভেঞ্চার শেষ হয়ে গিয়েছে, কিন্তু কে জানতো আমাদের এডভেঞ্চারের শেষ দৃশ্য এখনো অনেক বাকি।
আমাদের গাইড পদ্মারপারে ফেরার জন্য স্থানীয় আরেকজনকে নিয়ে নিল ঠিকমত রাস্তা চিনিয়ে নেয়ার জন্য। আমরা তিনজন সাথে দুইজন গাইড। সকাল সকাল সব পাহাড়ি রাস্তাই ভেজা থাকে, খুব সাবধানে নামতে হচ্ছিল পাহাড় থেকে। গাইড আমাদের আশ্বস্ত করলো রাস্তা বেশি কঠিন না, আমরা খুব শীঘ্রই পৌঁছে যাব পদ্মার পাড় ।
এখানেও আবার নদীর এপার থেকে ওপারে যেতে হলো ভিজে ভিজে। নৌকা কিংবা সাঁকোর কোন বালাই নেই, পাহাড়িরা এভাবেই চলাচল করতে অভ্যস্ত।
নদী পারাপার
নদী পার হতেই একটা পাহাড়, সহজেই পার হয়ে গেলাম। গাইড বললো আরেকটা পাহাড় পার হলেই আমরা পদ্ম পাড়ের ঝিরিতে গিয়ে উঠবো আর সেই ঝিরি ধরে আস্তে করে এগুলেই একসময় পদ্ম পাড়ের মুখে চলে যাব।
আমরা যে রাস্তা ধরে এগুচ্ছিলাম সেগুলো সবই পাহাড়ি রাস্তা। আমরা আরেকটা পাহাড় পার হয়ে গেলাম। গাইডকে বললাম, তাহলে কি আমরা চলে এসেছি? গাইড মাথা নাড়িয়ে বললো এইতো আরেকটু সামনে। ইতিমধ্যে ছোটবড় প্রায় তিনটার মত পাহাড় পার হয়ে গেছি। কাঁধে ভারী ব্যাগ থাকায় হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। পুরো শরীর ক্লান্তিতে ভরে গেছে। চারপাশে তাকালাম, এ এক নয়নভিরাম সৌন্দর্য্য! এত কষ্ট হবার পরেও মানুষ যে বারবার পাহাড় ঘুরতে আসে হয়তো এ সৌন্দর্য্য দেখার জন্যই।
আকাশের নানা রঙ
আকাশের নানা রঙ
কয়েক বোতল পানি ভরে নিয়ে এসেছিলাম, আর সাথে কিছু সিভিট এর প্যাকেট। রাস্তায় বিশ্রাম নেয়ার সময় শরবত বানিয়ে খেলাম। প্রচুর পরিমান ঘাম হবার কারনে শরীর সহজেই ক্লান্ত হয়ে যায় আর শরবত খাবার পরে সেই ক্লান্তি কিছুটা হলেও কমে।
একটা পাহাড় পার হবার সময় সত্যিই বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, অনেক উঁচু পাহাড়। পাহাড়ের গা ঘেঁষে একদম সরু রাস্তা। রাস্তায় দাঁড়িয়ে নীচের দিকে তাকালে গা ছমছম করে, যদি কোন কারনে পা পিছলে নীচে পড়ে যাই আমাকে কেউ খুঁজেই পাবেনা। আমরা সবাই পাহাড়ের গা ধরে ধরে সামনে এগুচ্ছিলাম। চারিদিকে তাকালাম, পাহাড়ের পর পাহাড়। রাস্তা এত বিপজ্জনক ছিল যে আমরা সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, ছবি তোলার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। এখন বেশ আফসোস হচ্ছে এ জন্য।
মনে হচ্ছে এ রাস্তা দিয়ে কিছুক্ষন আগেই গরুর পাল গিয়েছে, কাদায় ভরপুর রাস্তায় গরুর পায়ের চিহ্ন ভালোভাবেই ফুটে উঠেছে। যেখানে এ চিকন রাস্তায় আমাদেরই হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে সেখানে গরুগুলো কিভাবে গেল! গাইড বললো এখানকার গরু গুলো এভাবেই বেড়ে উঠে, গরুর ঘাড়ে কখনোই দড়ি পরানো হয়না, বরঞ্চ মাঠে ছেড়ে দেয়া হয় খাবারের জন্য। পাড়ায় দেখেছিলাম কোন গরুই দড়ি বাঁধা ছিলনা, আর এক একটা গরুর পা আর ক্ষুর এত মোটা যে এক লাথি খেলে জন্মের শিক্ষা হয়ে যাবে। পাহাড়ি ঘাস পাতা খেয়ে গরুগুলো এত মোটা তাজা হয় যে মনে হবে গা থেকে তেল চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে।
এ সরু কাদামাখা রাস্তায় আমি স্যান্ডেল পায়ে হাঁটতে পারছিলাম না, তাই স্যান্ডেল হাতে নিয়ে সামনে এগুতে লাগলাম। গাইড বললো এ রাস্তায় জোঁক এর ভয় আছে, তাই স্যান্ডেল পায়ে নিয়ে রাখাই নিরাপদ। এই পাহাড়টা পার হবার পর আমি আবার স্যান্ডেল পরে নিলাম কিন্তু নওশাদ এর পায়ে ঠিকই জোঁকে ধরেছে, এতক্ষণ ধরে টের পায়নি, কিন্তু পা থেকে রক্ত পড়তে দেখে বুঝলো জোঁকে ধরেছে। জোঁকে ধরার পর আমরাও ভয় পেয়ে গেলাম, ব্যাথা তেমন কিছুই না কিন্তু ভয়টা সংক্রামক।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে অন্য একটা পাড়ায় চলে এসেছি, খুব সম্ভবত নাম হরিচন্দ্রপাড়া। পাহাড়ের উপরে কয়েকটা ঘর নিয়ে পাড়াটা গড়ে উঠেছে। গাইড বললো পদ্ম পাড়ের ঝিরি আর অল্প কিছু দুরেই। এ পাড়ার লোকেরা হয়তো সেখান থেকেই পানি সংগ্রহ করে। আমরা গাইডকে কিছু বললাম না, মন চাইছিল তাকে একটা পিটানি দেই। কি দরকার ছিল আমাদের যে পদ্মার পাড় কাছেই, আমরা প্রায় তিন ঘন্টা ধরে হাঁটছি কিন্তু এখনও পদ্মা পাড়ের ঝিরিতেই পৌঁছাতে পারলাম না, আসল পদ্মার পাড়ে যেতে যে কত সময় লাগবে খোদা মালুম।
হরিচন্দ্র পাড়া, মনে হচ্ছে রুপকথার লোকেরা এরকম বানানো বাড়িতে থাকে
হরিচন্দ্র পাড়া
অনেক ক্লান্ত লাগছিল বিধায় আমরা এ পাড়ায় কিছুক্ষন বিশ্রাম নিলাম। আমাদের সাথে ইতিমধ্যে ঠুসাই পাড়া থেকে আরো দুইজন লোক যোগ হয়েছে। তারাও থানচি যাবে। আমাদের এখানে আসতে তিনঘণ্টার মত সময় লেগেছে অথচ তারা নাকি এখানে মাত্র এক ঘন্টার মধ্যে চলে এসেছে, তার মানে পাহাড়িরা আমাদের চাইতে প্রায় তিনগুন বেশি গতিতে হাঁটে।
হরিচন্দ্র পাড়া
চলবে...