টপিকঃ গহীন বান্দরবান: পর্ব-৭
পর্ব-৭ঃ একটা এক্সিডেন্ট এবং আবার যাত্রা
চোখের পলকেই ঘটনাটা ঘটে গেল যার জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। পানিতে ঝুপ করে পড়ার শব্দ আর চিৎকারে আমরা সবাই ওদিকে তাকালাম। আমাদের শিহাব পানিতে পড়ে গেছে। একটু আগেও ওকে কিনারায় বসে থাকতে দেখেছিলাম, কিভাবে কি ঘটে গেল চিন্তাই করতে পারছিলাম না। শিহাব সাঁতার জানেনা। আবার ওর পানিভীতি প্রচন্ড, তারপরও কোনদিক দিয়ে যে পানিতে পড়ে গেল!
পড়ার সাথে সাথেই আমাদের সাথে থাকা গাইড পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো। আরেক পাশ দিয়ে অন্য আরেক জন গাইড ঝাঁপ দিল। পানিতে গোসল করতে থাকা আরেকজন এগিয়ে আসছিল। গাইড দুজন মুহুর্তের মধ্যেই শিহাব এর কাছে পৌঁছে গিয়েছিল কিন্তু পানির প্রচন্ড স্রোতের মধ্যে কিছুতেই শিহাবকে ধরে রাখা যাচ্ছিল না। এর মাঝে শিহাব কয়েকবার হাবুডুবু খাচ্ছিল। পানিতে গোসল করতে থাকা অন্য আরকেজন ইতিমধ্যেই ওদের কাছে পৌঁছে গিয়েছে। তিনজন মিলে শিহাবকে টেনে কিনারায় নিয়ে আসার চেষ্টা করছিল। প্রচন্ড স্রোতে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু দূর চলে গেছে ওরা।
সবকিছু এত দ্রুত ঘটে যাচ্ছে যে হিতাহিত কি করতে বুঝে উঠতে পারছিলাম না। বেশ কিছুক্ষনের চেষ্টায় অবশেষে ওরা তিনজন শিহাবকে টেনে কিনারায় নিয়ে আসলো। মনে হচ্ছিল আল্লাহ একেবারে নিজ হাতে নিশ্চিত বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। নিজেদেরকে খুব সৌভাগ্যবান মনে হলো।
শিহাবকে টেনে তোলা হচ্ছে
কিছুক্ষনের জন্য সবাই স্থবির হয়ে গিয়েছিলাম। চারিদিকে লোক জমে গিয়েছিল। কোন ধরনের বিপদ হয়নি, এই রক্ষা। এই ঘটনার পর পানিতে নামার তো আর প্রশ্নই আসেনা। আমাদের যে দুইজন পানিতে নেমেছিল, তারাও কিছুক্ষন পর পানি থেকে উঠে এলো। আর কেউই পানিতে নামেনি।
কিছুক্ষন এখানে আশেপাশে ঘুরে ছবি তুললাম। আমাদের এখান থেকে সজীব এর ফিরে যাবার কথা, আর বাকী পাঁচজন একসাথে যাব আমিওখুম। কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনায় আমাদের সিদ্ধান্ত বদলাতে হলো। বিশেষ করে এরকম রাস্তায় সারাদিন হেঁটে যাবার জন্য অনেকেই রাজী ছিলনা। তাই সিদ্ধান্ত হলো সজীব, শিহাব আর তারেক ফিরে যাবে বান্দরবান শহরে আর আমি, নওশাদ আর সাইফুল ভাই আমাদের পুর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আমিয়াখুম যাব। ওরা তিনজন বাকী কয়দিন বান্দরবান শহরেই ঘুরবে আর আমরা আমিয়াখুম থেকে ফিরে এসে একসাথে ঢাকা ফিরে যাব।
নাফাখুমের চূড়ায়
আবার শুরু হলো হাঁটা। আমাদের সাথে একজন গাইড সহ টোটাল চারজন। সকাল থেকে হাঁটছি বলে শরীরের শক্তি বেশি একটা নেই তাই হাটাঁর স্পিড ও যাচ্ছে তাই। আর কিছুক্ষণ পরপরই বিশ্রাম নেবার জন্য বসছি। গাইড নিশ্চয়ই আমাদের দেখে ভাবছে আমরা যেন ফার্মের মুরগীর মনুষ্য ভার্সন। পানির বোতল সব খালি হয়ে গেছে, ভরে নিতে হবে। কিছুদূর পর পাহাড় বেয়ে নিমে আসা ছোট ঝর্নার মত এক জায়গা দিয়ে পানি নেমে আসছে, আর পানি পড়ে যাওয়ার মুখে বাঁশ দিয়ে পানি সংগ্রহ করার ব্যবস্থা আগে থেকেই করা আছে। বুঝলাম, এজায়গা থেকে স্থানীয়রা সবসময় পানি সংগ্রহ করে।
আমাদের গাইড পানি পান করছে
আবার হাঁটা শুরু। সে এক বিচিত্র ধরনের রাস্তা। কখনো পাথুরে, কখনো কাদাভর্তি আবার কখনো সবুজ ঘাসে ভরা মাটি। হাতের লাঠি ভর দিয়ে ঠকঠক করে এগিয়ে চলছি। ঘামে একাকার হয়ে এপর্যন্ত্য কয়েকবার গোসল হয়ে গেছে। এডভেঞ্চার করতে আসছিলাম, এখন সেই এডভেঞ্চার সব রস হয়ে বেরুচ্ছে। তাও ভাল্লাগে।
একপাশে পাহাড় আর একপাশে ঝিরিপথ
এই ছবিটাই বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করেছিলাম।
দুপুর তখন প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে। দিনের মাত্র অর্ধেকটা সময় পার হয়েছে, কিন্তু আমাদের কাছে মনে হচ্ছে যেন কয়েকদিন ধরে হাঁটছি। শরীরে আর বিন্দুমাত্র শক্তি অবশিষ্ট নেই, যেকোন মুহুর্তে পড়ে যেতে পারি। পাহাড় ঘেরা আঁকাবাঁকা পথ পার হয়ে একজায়গায় অল্প পানির স্রোত, হাঁটু পরিমান পানি হবে । ভালোয় ভালোয় পার হয়ে এলাম। এরপরই বিশাল এক খোলা জায়গা।
উপরে নীল আকাশ, চারপাশে পাহাড়, মাঝখানে খালি জায়গা, একপাশে নদী বয়ে গেছে। একটা জায়গা এত সুন্দর হতে পারে, নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতাম না। এতদিন শুধু ছবিতেই এরকম জায়গা দেখেছি, এখন একেবারে নিজের চোখের সামনে। এরকম ভয়ংকর সুন্দর জায়গা দেখে নিমিষেই সকল ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। গাইডকে বলে এখানে কিছুক্ষণ থামলাম। মাথার উপরে গনগনে সূর্য্য, প্রচন্ড রোদ। তাও বেশ খানিক্ষণ সময় কাটালাম। জায়গাটার নাম মনে সম্ভবত “আউলাওয়া পাড়া”, ভালো মনে করতে পারছি না।
আউলাওয়া পাড়া
আবার হাঁটা শুরু করলাম, রাস্তায় এক স্থানীয়ের সাথে দেখা হওয়ায় আমাদের গাইড তাকে আমাদের সাথে নিয়ে নিলো। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ঠুসাই পাড়া, এই লোক ঠুসাই পাড়ার আশেপাশেই থাকে, আমাদের সাথে থাকলে রাস্তা চিনতে সুবিধে হবে।
গাইডকে জিজ্ঞাসা করলাম, আর কতক্ষণ লাগবে পৌঁছাতে? গাইড বললো, এইতো কাছেই, অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাব। কিন্তু সেই অল্প কিছুক্ষণ আর শেষ হয়না। হাঁটছি তো হাঁটছি, যুগ যুগ ধরে হাঁটছি। তাও রাস্তা শেষ হচ্ছে না। আমরা এতক্ষণ ধরে পুরো রাস্তা পার হয়েছি একই নদীর পাশ ধরে। নদীর কোথাও অল্প পানি আবার কোথাও গভীর। এক জায়গায় পানির স্রোত দেখে মনে হচ্ছিল যদি পানিতে একটু শুয়ে থাকতে পারতাম! বাকী দুইজনকে বললাম, শুনেই রাজী হয়ে গেলো। একবারে গোসল হয়ে যাবে।
গাইড এর কাছে ব্যাগ রেখে আমরা তিনজন পানিতে নেমে পড়লাম। একদমই অল্প পানি, মাথাটা একটু উপরে রেখে পানির স্রোতের মধ্যে শুয়ে পড়লাম। স্রোতের বেগ খুব একটা ছিলনা, অল্প অল্প করে ভেসে যেতে থাকলাম পানিতে। কিছুক্ষণ পর পর শুয়ে থাকা অবস্থায় মাথা পানিতে ডুব দিলাম। এ এক অন্য রকম অনুভূতি। এতক্ষণ প্রচন্ড রোদে যে পরিমান কাহিল হয়ে গেছিলাম, এখন অল্প স্রোতের নদীর ঠান্ডা পানিতে গোসল করে পুরো শরীর ঝরঝরে হয়ে গেলো।
গোসল সেরে ভেজা প্যান্ট নিয়েই হাঁটা শুরু করলাম। যে পরিমান রোদ, তাতে কাপড় শুকানো সময়ের ব্যাপার মাত্র। গাইডকে জিজ্ঞাসা করলাম, আর কতক্ষণ লাগবে? গাইড দূরে একটা পাহাড় দেখিয়ে বললো, এ পাহাড় পার হলেই ঠুসাই পাড়া। আমরা সেখানেই থাকবো।
চলবে...