২১

Re: বঙ্গ ভঙ্গ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই

২২

Re: বঙ্গ ভঙ্গ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই

বঙ্গ ভঙ্গ ও মুসলমানদের নব চেতনার উন্মেষ

১৯০৩ সালে বড় লাট লর্ড কার্জন ঢাকায় সফরে এলে নওয়াব সলিমুল্লাহ পূর্ব বাংলার সমস্যাগুলো তুলে ধরে এতদাঞ্চলের দারিদ্র পীড়িত জনগোষ্ঠীর জন্য গ্রহণযোগ্য কিছু একটা করার আবেদন জানান। ওদিকে আসামের উৎপাদিত চা ও অন্যান্য পণ্য বিদেশে রপ্তানীর ব্যাপারে পরিবহন ব্যয় হ্রাসের উদ্দেশ্যে কোলকাতার বদলে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের চিন্তা করে বৃটিশরা, এই সাথে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীর প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের ভাবনাও চলতে থাকে। বৃটিশদের বাণিজ্যিক স্বার্থ এবং নবাবের আবেদন যুক্ত হয়ে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে বাংলা বিভাজনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে পলাশী উত্তর ভাগ্যবান জনগোষ্ঠী ব্রাহ্মণ্যবাদীরা জ্বলে উঠল। কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবি ব্যবসায়ীদের তীব্র প্রতিবাদ সত্বেও ১৯০৫ সালে পূর্ব বঙ্গ ও আসাম নিয়ে একটি স্বতন্ত্র প্রদেশ গঠন করা হল। বঙ্গভঙ্গ বর্ণ হিন্দুদের জন্য মোটেও সুখদায়ক হয়নি। বঙ্গভঙ্গের উপর আঘাত হানার জন্য শ্রেণী স্বার্থে তৎপর হয়ে উঠল তারা। ১৯০৩ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯০৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত অন্তত ৩০০০ প্রকাশ্য জনসভায় বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান হল এবং প্রতিটি জনসভায় ৫০০ থেকে ৫০,০০০ শ্রোতা উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে।
দলিত নেতা ডক্টর আম্বেদকর লিখেছেন- বাঙালী হিন্দুরা সমগ্র বাংলা উড়িষ্যা আসাম এমনকি ইউপিকেও তাদের কর্মক্ষেত্রে পরিণত করেছিল। এসব অঞ্চলের সিভিল সার্ভিসের পদসমূহে তারাই অধিষ্ঠিত ছিল। বাংলা বিভাগের অর্থ ছিল তাদের বিরাট কর্মক্ষেত্রের ক্ষতি হওয়া। বাঙালী মুসলমানরা যেন পূর্ব বাংলায় তাদের স্থান দখল করতে না পারে সেটাই ছিল হিন্দুদের কাম্য। বিশেষত এসব কারণেই তারা বঙ্গ বিভাগের বিরোধিতা করেছিল।

১৮৮৫ সালে সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। হিন্দু জনগোষ্ঠী শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রগামী হওয়ার কারণে এর সার্বিক নেতৃত্বে তারাই সমাসীন হন। ভারতবাসীর একক সংগঠন হিসেবে কংগ্রেস তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখে। ১৮৭৭ সালে আমীর আলীর উদ্যোগে ‘সেন্ট্রাল মোহামেডান এ্যাসোসিয়েশন’ গঠনের সাথে স্যার সৈয়দ আহমদ দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি মুসলমানদেরকে রাজনীতি থেকে বিরত থাকার উপদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু কংগ্রেস আত্মপ্রকাশ করার পর হিন্দি এবং উর্দুর বিরোধ সৃষ্টি হলে মুসলমানদের স্বার্থের ব্যাপারে সৈয়দ আহমদ সচেতন হয়ে উঠেন এবং ১৮৮৯ সালে রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ‘ইউনাইটেড ন্যাশনাল ডিফেন্স এ্যাসোসিয়েশন’ গঠন করেন (১৮৮৯)। ১৮৯৩ সালে উত্তর ভারতে মোহমেডান ‘এ্যাংলো ওরিয়েন্টাল ডিফেন্স অরগানাইজেশন অব আপার ইনডিয়া’ গঠিত হয়। ১৯০৩ সালে সাহরানপুরে মুসলিম রাজনৈতিক সংস্থা গঠিত হয়। ১৯০৬ সালের ফেব্রুয়ারীতে পাঞ্জাবে ‘মুসলিম লীগ’ নামে একটি রাজনৈতিক সংস্থা গঠিত হয়। এইভাবে উপমহাদেশে সব অঞ্চলের মানুষ রাজনীতি সচেতন হয়ে উঠে এবং স্থানীয় পর্যায়ে সংগঠিত হতে থাকে। কিন্তু সকলেই তাদের সীমাবদ্ধতার ব্যাপারেও অবগত ছিলেন। বৃটিশ ভারতের সমস্যা মোকাবেলার জন্য স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক শক্তি মোটেও যথেষ্ট ছিল না। এ কারণে সর্বভারতীয় সংগঠনের ব্যাপারে আগ্রহ সবার অবচেতন মনে দানা বেঁধেছিল। এদিকে বঙ্গভঙ্গের প্রতিক্রিয়ায় সমগ্র ভারত জুড়ে হিন্দু জনগোষ্ঠীর তুলকালাম কাণ্ড এবং মুসলিম বিদ্বেষের ঝড় বয়ে যাওয়ায় স্যার সলিমুল্লাহকে দারুণভাবে ভাবিয়ে তোলে। তিনি সর্বভারতীয় পর্যায়ে মুসলিম ঐক্যের কথা ভাবতে শুরু করেন। তিনি মনে করেন হিন্দু ষড়যন্ত্রের প্রতিরোধ সর্বভারতীয় পর্যায়ে হওয়া প্রয়োজন।

১৯০৬ সালের নভেম্বরে সলিমুল্লাহ সমগ্রভারতের বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দের নিকট পত্রালাপে নিজের অভিপ্রায় তুলে ধরলেন এবং সর্বভারতীয় মুসলিম সংঘের প্রস্তাব রাখলেন। এর প্রতিক্রিয়া হল দারুণ। সকলেই এমন একটি প্রস্তাবের প্রতীক্ষায় ছিলেন। সলিমুল্লাহর ডাকে সকলেই সাড়া দিলেন। ১৯০৬ সালের ২৮-৩০শে ডিসেম্বর সর্বভারতীয় শিক্ষা সম্মেলন আহুত হল। শাহবাগে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে সমগ্র ভারতের প্রায় ৮ হাজার প্রতিনিধি যোগ দিলেন। নবাব সলিমুল্লাহ ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম কনফেডারেন্সী’ অর্থাৎ সর্বভারতীয় মুসলিম সংঘ গঠনের প্রস্তাব দেন; হাকিম আজমল খান, জাফর আলী এবং আরো কিছু প্রতিনিধি প্রস্তাবটিকে সমর্থন করেন। কিছু প্রতিনিধির আপত্তির প্রেক্ষিতে কনফেডারেন্সী শব্দটি পরিত্যাগ করে লীগ শব্দটিকে গ্রহণ করা হয়। অবশেষে সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ গঠিত হয়। ঢাকায় এই ঐতিহাসিক সম্মেলনে বঙ্গভঙ্গ সমর্থন এবং বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের নিন্দা করা হয়। এ সংগঠনের ব্যাপারে শুরু থেকেই হিন্দু জনগোষ্ঠী বিরূপ অবস্থান নেয়। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী সম্পাদিত দি বেঙ্গলী পত্রিকা নবগঠিত মুসলিম লীগকে সলিমুল্লাহ লীগ হিসেবে অভিহিত করে। একে ভাতাভোগী তাবেদারদের সমিতি বলে বিদ্রুপ করা হয়। তা সত্ত্বেও নিরাশার তীরে বসে থাকা মুসলিম জনগোষ্ঠী চঞ্চল হয়ে উঠে। বঙ্গভঙ্গের ফলে সুদীর্ঘকালের অবহেলিত পূর্ববাংলায় নতুন উদ্দীপনার সঞ্চার হয়। সরকার এই প্রদেশের উন্নয়নের ব্যাপারে অনেকটা গা ঝাড়া দিয়ে উঠে। অত্যন্ত দ্রুত শিক্ষার প্রসার হয়। মাত্র ৫ বছরের মধ্যে ৩৫ শতাংশ ছাত্র বৃদ্ধি পায়।

বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে হিন্দু এবং মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে দূরত্ব রচিত হয়। বর্ণবাদী হিন্দু জমিদার ব্যবসায়ী এবং বুদ্ধিজীবিদের প্ররোচনায় সামগ্রিকভাবে হিন্দু জনগোষ্ঠী হিংস্র হয়ে উঠে। সমগ্র উপমহাদেশব্যাপী মুসলিম বিদ্বেষ এবং বৈরিতার ঝড় বয়ে যায়। মুসলমানদের উপর হিন্দুরা হিংস্র এবং খড়গহস্ত হয়ে উঠে। ঐতিহাসিক এম. এ. রহিম এনসি ঘোষের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন- ‘বঙ্গভঙ্গের ফলে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিদ্বেষ দেখা দেয়। মুসলমানদের প্রতি হিন্দুদের এইরূপ বিতৃষ্ণার সঞ্চার হয় যে, তাহাদের মধ্যকার বন্ধুত্ব ও বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন স্বদেশী আন্দোলন থেকে ব্যাপক সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের রূপ নেয়। পরে ক্রমশতা সীমিত হয়ে আসে। লর্ড মার্লো, লর্ড মিন্টো ও বৃটিশ সরকারের বড় কর্তা ছোট কর্তারা মুসলমানদের আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, বঙ্গ বিভাগ ব্যবস্থা একটা Settled fact কখনও এর পরিবর্তন হবে না। ১৯১১ সালে বৃটিশ সরকার সম্পূর্ণ গোপনে এমনকি বৃটিশ পার্লামেন্টকে না জানিয়ে সম্রাটের অনুশাসন হিসেবে Settled fact কে unsettled করে দিল। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ উল্লসিত হয়ে উঠলেন, মুসলিম নেতৃবৃন্দ প্রচন্ড আঘাতে মুহ্যমান হলেন।

১৯১২ সালে মার্চ মাসে কোলকাতায় অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে নওয়াব সলিমুল্লাহ বলেন- ‘যখন বঙ্গ বিভাগ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত র্পযায়ে তখন প্রতিপক্ষগণ বিরূপ হয়েছিলেন, বাস্তবে এর ফলে আমাদের বিশেষ লাভ হয়নি। কিন্তু যেটুকু আমরা পেয়েছিলাম তাও আমাদের স্বদেশবাসীরা আমাদের নিকট থেকে কেড়ে নেয়ার তীব্র আন্দোলন চালিয়েছে। হিন্দু জমিদাররা মুসলমানদেরও এ আন্দোলনে নামানোর চেষ্টা করেছে, মুসলমানরা এতে সাড়া দেয়নি। ফলে হিন্দু মুসলিম বিরোধ হয়েছে।’

মওলানা মোহাম্মদ আলী বঙ্গভঙ্গ রদ প্রসঙ্গে বলেনঃ এ যেন মুক্তিপ্রাপ্ত গোলামকে আবার গোলামীতে আবদ্ধ করা হল। এরপর মুসলমানরা আরো সচেতন ও সতর্ক হয়ে উঠল।
ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বৃটিশরা পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের আহত আত্মায় কিছুটা সান্ত্বনার প্রলেপ দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু কোলকাতায় বর্ণ হিন্দুরা সেটাকেও সহ্য করতে পারল না। সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় একদল হিন্দু প্রতিনিধি সহকারে ভাইসরয়ের সাথে সাক্ষাৎ করে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তীব্র প্রতিবাদ জানান। বঙ্গভঙ্গ রদ ছাড়াও আরো কতিপয় বৃটিশ কর্মকান্ড মুসলমানদের বিক্ষুদ্ধ অন্তরের জ্বলন্ত অঙ্গারে তেল ঢালে। বৃটিশ সরকার ইটালীর ত্রিপোলী আক্রমণকে সমর্থন জানায়। আলীগড়ে মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ব্যাপারে সরকার গড়িমসি করতে থাকে। এর ফলে মুসলিম জনগোষ্ঠী আরো বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে। সমকালীন মুসলমানদের বিক্ষুব্ধ চেতনা মুসলিম লীগকে এমনি প্রভাবিত করে যে, শেষ পর্যন্ত মুসলিম লীগ প্রবীণদের রাজভক্তির নীতি পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয় এবং বৈপ্লবিক কর্মসূচী গ্রহণ করে। ১৮৯২ সালের ৩১শে ডিসেম্বর বাকীপুরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের সভায় মাওলানা মোহাম্মদ আলী, সৈয়দ ওয়াজির হাসান এবং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উদ্যোগে গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়, ভারতে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা মুসলিম লীগের লক্ষ্য। স্বাধীনতাকামী প্রগতিশীলদের সমাবেশ হওয়ার ফলে মুসলিম লীগ ক্রমশ গতিশীল হয়ে উঠে।
মুসলিম অভিজাত শ্রেণীর অভ্যস্ত সৌজন্যের নীতি বর্জন করে ১৯১৩ সালের এপ্রিলে বাংলার ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্যরূপে ভাষণ দানকালে এ কে ফজলুল হক বলেন- ‘মুসলমানদের দাবীর প্রতি ক্রমাগত উপেক্ষা করে চললে বিপদের সম্ভাবনা আছে।... আমরা সরকারের বহু প্রস্তাবের মধ্যে প্রচুর আশ্বাসের কথা শুনেছি। কিন্তু বঙ্গভঙ্গের বাস্তব সত্য যেরূপ মুসলমানদের উপকারে আসেনি।
ফজলুল হক আরো বলেন- ‘আমি বঙ্গভঙ্গ রদের বিষয় উল্লেখ করে শুধু এটাই বুঝাতে চাচ্ছি যে, সময়ের ব্যবধান হলেও মুসলমানরা এমন কোন ব্যবস্থা মেনে নিতে পারেনা যার ফলে তার আত্মসম্মানে আঘাত লাগতে পারে।’ ফজলুল হকের এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মুসলিম লীগে তারুণ্যের অগ্রযাত্রা শুরু হয়।

সর্বশেষ সতর্ক সংকেত
১৯৩৫ সালের শাসনতন্ত্র অনুযায়ী ১৯৩৭ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে কংগ্রেস ৬টি প্রদেশে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। ১৯৩৭ সালের ১লা জুলাই থেকে ১৯৩৯ সালের ১৫ই নভেম্বর/২২ই ডিসেম্বর পর্যন্ত কংগ্রেস প্রাদেশিক মন্ত্রীসভায় ক্ষমতাসীন ছিলো। ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ যে হিংস্রতা, যে বর্বরতা ও আদিম আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে ছিল সেটাই মুসলমানদেরকে তাদের অনিবার্য পরিণতির ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছিল। কংগ্রেসী শাসনের অভিজ্ঞতা এমন এক উদ্দাম প্রেরণার সৃষ্টি করেছিল যে, তারা ভারত ভেঙে পাকিস্তান অর্জন না করা পর্যন্ত ক্ষান্ত হয়নি।

এই কংগ্রেসী শাসনামলে উপমহাদেশের মুসলমানরা যে তিক্ত অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল সেটাই পরবর্তীকালে স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মূল প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল। দু’ বছর কাল স্থায়ী কংগ্রেসী মন্ত্রীসভার মেয়াদে ত্রিশটি সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা অনুষ্ঠিত হয়। ফয়েজাবাদের টান্ডা নামক ছোট শহরে ৭০ জন মুসলমান পুলিশের গুলীতে নিহত হয়। ২শ’ জন মুসলমানকে শিকল বেঁধে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরানো হয়। এমনকি মসজিদের মধ্যে প্রবেশ করে তাদের দড়ি দিয়ে বাধা হয়। মধ্য প্রদেশের চাঁদপুরে চারশো মুসলমানকে দড়ি দিয়ে পা বেঁধে টেনে হেঁচড়ে আদালতে হাজির করান হয়। সরকারী কর্তৃপক্ষ ১৫০ জন নরনারী ও শিশুর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। দু’জন মুসলমানকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় এবং ২৪ জনকে দেয়া হয় দ্বীপান্তর।

এ সময় শেরে বাংলা ফললুল হক তার বিবৃতিতে বলেন- ‘কংগ্রেসী নীতির দরুণ এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে অদলীয় সরকারসমূহ কর্তৃক আরোপিত বিধি নিষেধের বেড়া মারমুখো হিন্দুরা ভেঙ্গে ফেলেছে। মুসলিম সংখ্যালঘুদের ওপর তারা নিজেদের ইচ্ছা চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে। এই ইচ্ছা কি?... গোমাতাকে সম্মান দেখাতে হবে। মুসলমানদের গরুর গোস্ত খেতে দেয়া হবে না। মুসলমানদের ধর্মকে অবমাননা করতে হবে। কেননা এটা হিন্দুদের দেশ, সে কারণে আযান বারণ করা, নামাজের সময় মসজিদের সম্মুখে হৈহুল্লোর করা ও বাজনা বাজিয়ে মিছিল করে নিয়ে যাওয়ার মত কাজ হচ্ছে। সুতরাং মর্মান্তিক ঘটনার পর মর্মান্তিক ঘটনা যদি ঘটে এবং দুধের নহরের পরিবর্তে রক্তের স্রোত যদি বয়ে যায় তাহলে বিস্ময়ের কি আছে?

স্টেটসম্যানের সম্পাদক আয়ান ষ্টিফেন লেখেন : যুক্ত প্রদেশ ও অন্যান্য স্থানের প্রাদেশিক মন্ত্রীরা রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে বাস্তাবায়িত করার বিষয়টা নিজেদের দৈনন্দিন কাজের অঙ্গীভূত করে নেন। এতে অহিন্দুদের মধ্যে বিরূপতা দেখা দেয়। মুসলমানদের ওপর সব রকম চাপ ও হয়রানী শোনা যেতে লাগল। স্কুলের ছাত্রদের হিন্দু পদ্ধতিতে জোড়হাতে মিঃ গান্ধীর প্রতিকৃতি পূজা করার ব্যবস্থা চালু করা হয়। বঙ্কিম চন্দ্রের আপত্তিকর উপন্যাসের বন্দে মাতরম সঙ্গীত ছাত্রদের গাইতে বলা হয়। গরুর গোস্ত খাওয়া বন্ধ করার জন্য সক্রিয় প্রচেষ্টা চলে। উর্দুভাষা ও বর্ণমালা বন্ধ করার ব্যবস্থা করা হয়। বড় বড় চাকুরিতে হিন্দুদের নিয়োগ করা হতে লাগল। দাঙ্গার সময় প্রশাসন হিন্দুদের পক্ষাবলম্বন করে।

কুপল্যান্ড লিখেছেন : কংগ্রেস পাশ্চাত্য গণতান্ত্রিক নীতি উপেক্ষা করে নিজেদেরকে পুরোপুরি ও চিরস্থায়ীভাবে জাতীয় সরকার হিসেবে গণ্য করতে শুরু করে। দুটো ছোটখাট ঘটনা থেকে এর প্রমাণ মেলে। প্রথমত ক্ষমতা লাভের সংগে সংগে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ পরিচালিত সংস্থাসমূহের ভবনের ওপর নিজেদের ত্রিবর্ণ পতাকা উড়ানো, এটা সংখ্যালঘুদের ওপর ছিল একটা চ্যালেঞ্জ স্বরূপ। দ্বিতীয়ঃ আইন পরিষদের উদ্বোধনীতে বন্দেমাতরম সংগীত গাওয়া। এটাও সংখ্যালঘুদের ওপর ছিল একটা চ্যালেঞ্জ। আর এটা ছিল অধিকতর আক্রমণাত্মক। কারণ বন্দে মাতরম সংগীতের কোন কোন ছত্রে ইসলামকে ক্ষুণ্ণ করে হিন্দুধর্মকে উচ্চাসন দিয়েছে। ফলে মুসলিম সদস্যরা ওয়াক আউট করেন।

ডক্টর বেনী প্রসাদ লিখলেন : এর পরেই কংগ্রেসী সরকার বিদ্যামন্দির চালু করার ব্যবস্থা করলেন। কথাটা যে শুধু সংস্কৃত তা নয়, পরন্তু এর অর্থ হচ্ছে বিদ্যার মন্দির। মন্দির কথাটি মূর্তিপূজা বিরোধীদের নিকট আপত্তিকর। মুসলমানদের তীব্র বিরোধিতার মুখে কংগ্রেস এ ধরণের কর্মকাণ্ড চালু করেছিলেন বটে কিন্তু আইন অমান্য আন্দোলনের চাপে শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হলেন।... মুসলিম লীগ অনুভব করেছিল যে, সংখ্যালঘুদের সুযোগ সুবিধার প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠরা মোটেও মনোযোগ দিচ্ছে না। ১৯৩৭ সালেই মুসলমানরা নিজেদের ভবিষ্যত ভেবে শঙ্কিত হয়ে পড়ে।

এল এফ রাশ ব্রুক উইলিয়াম লিখলেন : কংগ্রেস শাসন থেকে সংখ্যালুঘুরা এই সত্যই উপলব্ধি করতে পারলো যে, প্রশাসনিক এমনকি শাসনতান্ত্রিক রক্ষাকবচ তাদের রক্ষা করতে পারবে না। কেননা বিষয়টা শাসকগোষ্ঠীর মানসিকতার সাথে জড়িত। আর শাসক দল অপরাপর দলগুলিকে রাজনীতির ক্ষেত্রে পরাজিত বলে মনে করে। তাছাড়া সমঝোতা বলে কোন শব্দ কংগ্রেসের ইতিহাসে আছে বলে মনে হয় না। কংগ্রেস কেবল নিজেকে প্রগতি প্রজ্ঞা ও দেশপ্রেমের সোলএজেন্ট বলে মনে করে।

জিন্নাহ বললেন, সামান্য ক্ষমতা হাতে পাওয়া মাত্রই শুরুতেই ক্ষমতাসীন সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় এটাই সুস্পষ্ট করে তুলে ধরেছে যে, হিন্দুস্থান হচ্ছে হিন্দুদের জন্য।’
ফ্রাঙ্ক মরিয়মের মতে, নির্বাচনের পর যদি কংগ্রেস মুসলিম লীগের সাথে সতর্কভাবে ব্যবহার করত তাহলে হয়তো পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হতো না। আজন্ম লালিত বৈরিতা ও মুসলিম বিদ্বেষ পোষন করা সত্ত্বেও মুসলমানরা উপমহাদেশের স্বাধীনতার সৌজন্যে মৈত্রির দুটো হাত বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু সাম্প্রদায়িক হিন্দু নেতৃত্ব মুসলমানদের উদ্দেশ্যে কেবল নিক্ষেপ করে ঘৃণা ঘৃণা এবং ঘৃণা। স্বাভাবিকভাবে নিরাপত্তাহীন মুসলমানরা তাদের নিশ্চিত বিপর্যয় থেকে নাজাত পাওয়ার জন্য নিজস্ব পথ এবং পদ্ধতির তালাশ করে। দূরদর্শী বিচক্ষণ কায়দে আযম হিন্দু মুসলিম ঐক্যের সপক্ষে সংগ্রাম করে ব্যর্থ হন। হিন্দু ষড়যন্ত্রের গভীরতা আঁচ করে ফিরে আসেন তার আপন বলয়ে। উপমহাদেশের ১০ কোটি মুসলমানের চূড়ান্ত পরিণতির কথা ভেবে তিনি শিউরে উঠেন। অবশেষে তার অনুভূতির গভীর থেকে উৎসারিত চেতনার নির্যাস দিয়ে দ্বিজাতি তত্ব পেশ করেন। জাতি যেন এর প্রতীক্ষায় ছিল এতদিন। তার এ তত্ত্বের বাস্তবতা ঝড় তোলে টেকনাফ থেকে খাইবার পর্যন্ত। অভিন্ন এক চেতনার সেতু নির্মিত হয় এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত। এখানে ভাষা উপেক্ষিত হয়। আঞ্চলিকতা উপেক্ষিত হয়। শ্রেণী উপেক্ষিত হয়। উপমহাদেশের আবালবৃদ্ধবনিতা দলমত নির্বিশেষে প্রতিটি মুসলমান একই চেতনার প্লাবনে ভেসে যায়।

পণ্ডিত নেহেরু যখন কোলকাতায় ঘোষণা করলেন, আজকের ভারতে মাত্র দুটো শক্তি রয়েছে একটি বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ অন্যটি কংগ্রেস। জিন্নাহ এর জবাব দিলেন, না দুটো নয় আর এক তৃতীয় শক্তি রয়েছে সেটা হল ভারতের ১০ কোটি মুসলমানের প্রতিষ্ঠান মুসলিম লীগ। ১৯৪০ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারী হিন্দু ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে মুসলমানদের উদ্দেশ্য করে বললেন : সেটা যদি আপনারা আজও বুঝে না থাকেন তাহলে আমি বলি আপনারা কখনও বুঝবেন না।... গ্রেট বৃটেন ভারত শাসন করতে চায়। মিঃ গান্ধী ও কংগ্রেস ভারত ও মুসলমানদের শাসন করতে চান। আমরা বলি বৃটিশ অথবা মিঃ গান্ধীকে মুসলমানদের ওপর শাসন করতে দেব না। ৬ই মার্চ বললেন... ‘যদি বৃটিশ সরকার মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী কোন প্রকার সমঝোতা কংগ্রেসের সংগে করে আমরা তা টিকতে দেব না।

২৩ সর্বশেষ সম্পাদনা করেছেন সেজান (২৭-০৪-২০১৫ ১৬:১৯)

Re: বঙ্গ ভঙ্গ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই

আমি যতটুকু সহজ ভাষায় বুঝি তা হচ্ছে আমাদের মুসলামনদের মধ্যে মনে হয় কুসংস্কারটা বেশি ছিল।আমরা ইংরেজদের অনেক কিছুই আপন করে নিতে পারছিলাম না।যেমন ইংরেজী শিক্ষাটা।সেই দিক থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ইংরেজদের অনেক কিছুই আপন করে নেয় এবং তারা শিক্ষাদীক্ষায় জ্ঞান চর্চায় সব দিক থেকেই এগিয়ে যায়।মুসলমানরা যখন অনুধাবন করল যে তাদের যদি এগিয়ে যেতে হলে ইংরেজদার এই সবের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে।ততদিনে এই অন্চলের বাঙালী হিন্দুরা সবজায়গায়  নেতৃত্বস্থানীয় পদে বা সব বড় বড় পোষ্টে তাদের জয়জয়কার।তাছাড়া রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে সব কিছুতে পিছিয়ে ছিল মুসলমানজনগোষ্ঠী।মুসলমানজনগোষ্ঠী যখন শিক্ষাদীক্ষা সব কিছুই থেকে হিন্দু জনগোষ্ঠী থেকে পিছিয়ে ছিল সুতরাং হিন্দুদের তো এই অন্চলে একটা প্রভাব ছিল।তারা হয়ত সবকিছুতে বাঙালী মুসলমান জনগোষ্ঠীর উপর একটা ডমিনেট করত বিশেষ করে হিন্দু জমিদাররা।তাই হয়ত মুসলমানদেরও ভিতরে একটা ক্ষোভ ছিল।তাছাড়া একটা ধর্মীয় ব্যাপার স্যাপার তো আছেই। এই ক্ষোভ আর ও বিরোধে পরিনত হল যখন বঙ্গ ভঙ্গ এর সিদ্ধান্ত নেওয়া হল।কারন হিন্দু সম্প্রদায় কোন মতেই চাচ্ছিল না যে বঙ্গ ভঙ্গ হোক।বঙ্গ ভঙ্গ হলে হয়ত সারা বঙ্গতে যে তাদের একটা প্রাধান্য বা তাদের বিরাট কর্মক্ষেত্রের ক্ষতি হতে সে একটা আশংকা তারা করছিল।
ততকালীন মুসলমান বুদ্ধিজীবি ও রাজনীতিক সংগঠন গুলো বঙ্গ ভঙ্গ এর পক্ষ নিলেও হিন্দু বুদ্ধিজীবি সমাজ বা সংগঠনগুলোর তীব্র চাপে বঙ্গ ভঙ্গ রদ হয়।এতে মুসলমান জনগোষ্ঠী অপমানিত বোধ করলেও হিন্দু জনগোষ্ঠী এতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে।ব্রিটিশরা মুসলমানদের এই ঘাতে মলম দেওয়ার জন্য এই অন্চলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়।১৯১২ সালে তারা নাথান কমিশন গঠন করে।এই কমিশন এর সুপারিশক্রমে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বঙ্গ ভঙ্গ এর  ভিতরে হয়ত আর ও কিছু থাকতে পারে আমি যতটুকু জানি তা সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করলাম।

আমাদের জাতীয় সংগীতও  ”আমার সোনার বাংলা” এই  বঙ্গ ভঙ্গ এর কারনেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করেছিলেন।যা ১৯০৫ সালে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় smile

অন্যের কাছ থেকে যে ব্যবহার প্রত্যশা করেন আগে নিজে সে আচরন করুন।

লেখাটি CC by-nc 3.0 এর অধীনে প্রকাশিত

২৪

Re: বঙ্গ ভঙ্গ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই

২৫ সর্বশেষ সম্পাদনা করেছেন সেজান (২৭-০৪-২০১৫ ১৬:২১)

Re: বঙ্গ ভঙ্গ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই

অন্যের কাছ থেকে যে ব্যবহার প্রত্যশা করেন আগে নিজে সে আচরন করুন।