টপিকঃ ডায়েরি - ১১ : ক্রিকেট
স্কুলের মাঠটা বেশ এবড়ো থেবড়ো। বর্ষাকালে পানি সরে যাওয়ার রাস্তা করে দিতে মাঠের মাঝখান দিয়ে নালা করে দেয়া ছিল, সেই নালা বছরের বাকীটা সময় এভাবেই পড়ে থাকতো। আর লম্বায় মাঠটা ছিল ফুটবল খেলার জন্য মানানসই, তাই ফুটবলের মৌসুমে মাঠের দিকে তাকানো যেত না, সারা মাঠ কাদায় ভরপুর। আপাত দৃষ্টিতে এই মাঠে ফুটবল খেলা ছিলে অনেক রিস্কি, কিন্তু এসব কেউ আমলেও নিত না। মৌসুম শেষ হয়ে গেলে ফুটবল খেলার আগ্রহ কমে যেত, আর তখনই শুরু হতো ক্রিকেট খেলা।
আমি ফুটবলে খেলতাম না, খেলতাম না বলতে খুব একটা পারতাম না। শরীরের হালকা পাতলা গড়নের কারনে খেলায় ধাক্কা, ফাউল আর ল্যাং এর নির্মম শিকার হতাম বিধায় এ খেলাটার উপর আমার আগ্রহ অনেক কম ছিল। সে তুলনায় ক্রিকেট অনেক পছন্দ করতাম, তাইতো অপেক্ষায় থাকতাম কখন ফুটবল খেলার মৌসুম শেষ হবে আর কখন ক্রিকেট খেলার সুযোগ পাব। স্কুলের মাঠ লম্বায় যথেষ্ট বড় হলেও ক্রিকেট খেলার মাঠ হিসেবে চওড়ায় বেশ ছোট ছিল। তারপরও খেলার জন্য এটা কোন বাধাই ছিলনা। বিকেলবেলা আমরা সবাই জড়ো হতাম খেলার জন্য। কখনো ভাগ বাটোয়ারা করে, কখনো এ পাড়া বনাম ও পাড়া করে খেলা হত।
প্রতিদিন ক্লাশ শেষ করে বাড়ী যেতাম। আম্মার কঠিন নির্দেশ ছিল, দুপুরে ভাত খাবার পর অবশ্যই ঘুমাতে হবে, অন্য কোথায় যাওয়া যাবেনা, খেলার তো প্রশ্নই আসেনা। এর কারন ছিল, দুপুরে না ঘুমালে সন্ধ্যা না নামতেই ঘুম আসতো, রাতের পড়াশোনা আর হতো না।
দুপুর বেলা ঘুমানোর নিয়মটা বিষের মত মনে হতো। আসলে ক্লাস শেষ করে বাড়ি ফিরে খাওয়া দাওয়া করার পর দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যেত। তখন যদি ঘুমাতে হয়, তাহলে বিকেলের খেলা মিস হয়ে যায়। তাইতো অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঘুমানোর জন্য বিছানায় যেতে হত। সারা সময়টা বিছানায় গড়াগড়ি করে কাটাতাম, না খেলতে পারার কষ্টে চোখে ঘুমের নামগন্ধও থাকতো না।
আম্মা বেশিক্ষণ পাহারায় রাখতে পারতো না। একটু চোখের আড়াল হলেই অন্য দরজা দিয়ে বের হয়ে যেতাম। আর রাস্তা ঘুরে অন্য জায়গা দিয়ে খেলার মাঠে চলে যেতাম যাতে ভুলেও আম্মার চোখে না পড়ি। সন্ধ্যাবেলা বাসায় ফিরে আসলে ঠিকই আম্মা বকা দিত, যথারীতি সারাদিনের দৌড়াদৌড়িতে শরীর অনেক ক্লান্ত থাকতো আর সন্ধ্যার কিছু পরেই চোখ ভেঙে ঘুম আসতো। আম্মার মারের ভয়ে যখন খুশি তখনি ঘুমানো যেত না। যাতে ঘুম না আসে, সেটা করার জন্য কত যে চোখে পানি দিয়েছি, পেয়াঁজের কুচি চোখের সামনে ধরেছি, কিন্তু কিসের কি! একবার ঘুম আসলে কোন কিছুতেই আর দমানো যেতনা। ঘুমতো ঘুমই, পড়ার টেবিলে মাথা দিয়ে, চেয়ারে বসে বসে অথবা দেয়ালে হেলান দিতে পারলেই হলো, মুহুর্তের মধ্যেই ঘুমের দেশে চলে যেতাম। আম্মা যখন টের পেত তার সুপুত্র পড়ার টেবিলে বসে বসে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে তখন আর কিছুই করার থাকতো না। আমিতো তখন ঘুমচ্ছি, দুনিয়ার খোঁজখবর কি আর আমার আছে!
একদিন গ্রামের এক বড় ভাই খবর দিলেন কিছুদিন পর আমরা পাশের গ্রামে খেলতে যাব। ওদের স্কুলের মাঠ আছে ওখানে। আমাদের গ্রামের বেশ কয়েক গ্রাম পরেই ঐ গ্রাম। সুতরাং ভালো করে খেলতে হবে, যদি হেরে যাই তাহলে একেবারে প্রেস্টিজ ইস্যু হয়ে দাঁড়াবে। সেদিন বিকেলে ঠিক করে ফেলা হলো কে কে খেলবে ওইদিন। তখন আলাদা করে কোন প্রাকটিস করতাম না। শুধু সবাই মিলে ভাগ করে খেলতাম। আর যারা ওই গ্রামের সাথে খেলার জন্য ঠিক হয়েছিল তারা আগে ব্যাট বা বল করার সুযোগ পেত। আমি মূলত বল করতাম, তাই সেদিনকার খেলায় বেশি পরিমানে বল করার সুযোগ পেয়েছিলাম।
যাদের যাদের সাইকেল ছিল তারা খেলার দিন সাইকেলে করে চলে যাবে আর যাদের সাইকেল নাই তারা হেঁটে যাবে। আমার সাইকেল ছিলনা, সুতরাং হেঁটে যাওয়াই একমাত্র উপায়। গ্রামটা বেশি দূর ছিলনা, মোটামুটি ঘন্টাখানেক হাঁটলেই পৌঁছানো যাবে। আমার মত আরো কয়েকজনের সাইকেল ছিলনা, তারা সহ এবং আরো কয়েকজন আমাদের পক্ষের সাপোর্টার নিয়ে একসাথে রওনা দিলাম। সাথে কয়েকজন সাপোর্টার না নিলে আমাদের পক্ষে হাততালি দেয়ার মত কেউ থাকবে না। সাপোর্টার বলতে বাড়ীর এবং বাড়ীর আশেপাশের ৮-১০ বছরের ছেলেপুলে গুলো। হাতে দুইটা বিস্কিট ধরিয়ে দিয়ে যা করতে বলবো তাই করবে।
খেলার সকাল সকাল শুরু হবার কথা থাকলেও আমাদের পৌঁছাতে পৌঁছাতে দেরী হয়ে গিয়েছিল। খেলাটা ছিলো স্কুল বন্ধের দিন, তাই সেরকম কোন দর্শক ছিলনা। স্কুলের মাঠের পাশে ধানক্ষেত ছিল, সেখানে লোকজন কাজ করছিল, আর পাশে দোকানের সামনে কয়েকজন লোক। এ হলো সব মিলিয়ে দর্শক। রোদের মধ্যে হেঁটে যাওয়াতে বেশ ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। মাঠের এককোণে একটা চাপকল ছিল, পানি একেবারে ঠান্ডা। ঢোক ঢোক করে পানি খেয়ে ক্লান্তি দূর করলাম।
খেলা শুরু হলো। গুটিকয়েকজন যা দর্শক ছিল তাদের হইহুল্লোড়ে আস্তে আস্তে আরো লোক জমায়েত হতে শুরু করলো। আমরা বেশ একটা সুবিধা করতে পারলাম না, বিশেষ করে আমার বলে তো বেধড়ক মার দিল। ঐ গ্রামের খেলোয়াড় গুলো বেশ শক্তিশালী ছিল, আস্তে করে মারলেই যেন ছক্কা হয়ে যায়। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যাকেই বল দেয়া হয় সেই মার খায়। কোন কিছুতেই কাজ হয়নি।
আমরা যখন ব্যাট করতে গেলাম, তখনও সেই একই অবস্থা। আমাদের ফিল্ডের বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানরা এক এক করে মাথা নিচু করে ফিরে আসতে লাগলো। তাই ফলাফল যা হবার হলো, আমরা শোচনীয় ভাবে হেরে গেলাম। খেলার শেষ মুহুর্তে সারা মাঠ লোকে লোকারন্য। আমরা হেরে যাব বলে মনে হয় লোকজনের ঢল নেমেছে। খেলা শেষে ঐ দলের ক্যাপটেন কে আমাদের গ্রামে খেলতে আসার আমন্ত্রণ জানালাম। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা ফিরে আসছি, পেছনে ততক্ষনে ঐগ্রামের লোকজন মিছিল শুরু করে দিয়েছে – “জিতিলো রে জিতিলো...”।
মিছিলের আওয়াজ খুব কানে বাঁধছিল, প্রেস্টিজ একেবারে পাংচার হয়ে একাকার হয়ে গেছে। মনে মনে ভাবলাম, আসুক আমাদের গ্রামে, তখন দেখিয়ে দিব খেলা কাকে বলে। আমরা দ্রুত স্থান ত্যাগ করে ফিরে এলাম।