টপিকঃ এক ফোঁটা পরিবেশ প্রকৌশল - ০৭ (কৃত্রিম জলাশয়ের পরিবেশগত প্রতিক্রিয়া)
পানি অমূল্য সম্পদ। যে কোনো অঞ্চলেই শুষ্ক মৌসুমে সাধারণত পানির অভাব হয়। পানযোগ্য পানির অভাব হলে পানীয় ও পরিচ্ছন্নতার অভাবে জীবন হানি ঘটবে; সেঁচের অভাবে ফসলের ক্ষতি হবে। আবার অন্য দিকে বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানির কারণে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ হতে হয়। এ্যাত পানি বর্ষায় যা সমূদ্রের লবণাক্ত পানিতে মিশে নষ্ট হচ্ছে, অথচ শীতে পানির অভাব। এই ধরণের সমস্যা সমাধাণের জন্য বর্ষার অতিরিক্ত পানি যদি কোনো একটা জলাধারে আটকিয়ে রেখে শুষ্ক মৌসুমে প্রয়োজনের সময় ব্যবহার করা যায় তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়। এমন সমস্যা সমাধাণের প্রয়োজন থেকেই কৃত্রিম জলাধার উন্নয়নের ধারণাগুলো এসেছে।
সাধারণত নদীর উজানের দিকে পাহাড়ি অঞ্চলে দুই দিকে পাহাড় থাকার কারণে, শুধু একদিকে একটা বাঁধ দিলেই বিরাট জলাধার তৈরীর জন্য সুবিধাজনক। এছাড়া উজানের পানি অপেক্ষাকৃত বেশি বিশুদ্ধ থাকে। তাই বেশিরভাগ দেশেই পাহাড়ের মধ্যে বাঁধ দিয়ে কৃত্রিম জলাশয় তৈরী করে সেখানে পানি জমিয়ে রাখা হয় (যেমন: কাপ্তাই লেক)। এই পানি দিয়ে শহরের পানি সরবরাহ, কৃষিতে সেঁচ দেয়া ছাড়াও বিনোদন (নৌকাবাইচ, সাঁতার, লেকের পাড়ে ঘুরে বেড়ানো, মাছধরা), জলবিদ্যূৎ উৎপাদন, বর্ষায় অতিরিক্ত পানি আটকে ভাটির বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি উপকারে লাগে। ভাটি অঞ্চলেও অনেক সময় নদীতে বাঁধ দিয়ে পানির উচ্চতা বাড়িয়ে পানি সরবরাহ ও সেঁচ প্রকল্প চালানো হয় (যেমন: তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প)। এছাড়া সমূদ্রের কাছাকাছিও এরকম বাঁধ দিয়ে নদীর সুপেয় পানির সাথে লবণাক্ত পানি মিশে যাওয়া ঠেকানো হয় (যেমন: সিঙ্গাপুরে মেরিনা রিজার্ভার)।
তবে, প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে যে কোন খবরদারীরই আরো কিছু প্রতিক্রিয়া দেখা যায় যা দীর্ঘমেয়াদে হয়তো লাভের বদলে ক্ষতির কারণ হতে পারে। এই ক্ষতিকর প্রভাবগুলো আগে থেকেই চিন্তাভাবনা করে যথাসম্ভব কমানোর জন্য ব্যবস্থা নিলে সেটা অনেক বেশি পরিবেশবান্ধব হয়ে উঠতে পারে।
বাঁধ দিয়ে পানি আটকিয়ে জলাধার তৈরী করলে সেটার প্রভাবসমূহ (যেমন, কাপ্তাই, তিস্তা ব্যারেজ, টিপাইমুখ ...)
১। জমানো পানির গুনাগুন পরিবর্তন হয় (ঋতূভিত্তিক)
২। বাষ্পীভবনের ফলে পানি নষ্ট হয় (ঋতূভিত্তিক)
৩। বাঁধের ভাটিতে পানির প্রবাহ কমে যায় এবং নদীর মোহনাতে পানি সুষম ভাবে আসে, ফলে লবণাক্ততা প্রবেশের ধরণ এবং মোহনার মাছের প্রজাতি পরিবর্তন ঘটে। (টিপাইমুখ হলে তাহলে ইলিশের কী হবে?)
৪। স্থানীয় ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের উচ্চতা এবং গুণাগুন পরিবর্তীত হয় (- এই ব্যাপারটা অনেকসময়েই কাঙ্খিত পরিবর্তন)
৫। পানির চাপের কারণে জলাধারের মধ্যে ভূমিধ্বস এবং/অথবা ঐ এলাকার ভূমিকম্প প্রবণতা বেড়ে যায়
৬। ঐ এলাকার মাইক্রো-আবহাওয়ায় পরিবর্তন ঘটে - অতিরিক্ত বায়ুপ্রবাহ, আর্দ্রতা, এবং/অথবা বৃষ্টিপাত
৭। খনিজ সম্পদ জলমগ্ন হয় / ডুবে যায়
৮। মাছের সংখ্যা এবং ধরণ পরিবর্তন ঘটে -- ঠান্ডা পানির মাছের বদলে উষ্ণ পানির মাছ
৯। পরিযায়ী মাছের বিচরণ ক্ষেত্র নষ্ট হয় -- (যেমন: কলম্বিয়া নদীতে স্যামন মাছ)
১০। টারবাইন এবং পাম্পের মধ্যে পরে মাছ নষ্ট হয় (টারবাইন বা পাম্পে পানি প্রবেশ পথে রক্ষাকারী জাল ব্যবহার করে এটা ঠেকানো যায়)
১১। জলাধারে নতুন ধরণের মাছ ফলনের সম্ভাবনা বাড়ে ( - এটা একটা ভাল ব্যাপার)
১২। মশা এবং সম্পর্কিত পোকামাকড়ের প্রজননক্ষেত্র বৃদ্ধি পায় - জনস্বাস্থে এর প্রভাব (ম্যালেরিয়া ইত্যাদি)
১৩। কচুরীপানা জাতীয় জলজ আগাছার বৃদ্ধি সূচনা করে
১৪। ডুবে যাওয়ার ফলে বণ্য প্রাণীর বিচরণক্ষেত্র নষ্ট, অর্থাৎ ঐ প্রাণীর জীবন ধারণ বাধাগ্রস্থ হয়
১৫। জলীয় আবাসস্থলের ধরণের পরিবর্তন: অগভীর, প্রবহমান আবাসস্থল থেকে গভীর জলাশয়ে পরিণত; পরিযায়ী পাখির উপর এর প্রভাব পড়বে (কারণ তাদের খাদ্য তথা মাছের ধরণ পাল্টিয়ে যাবে)
১৬। দূর্লভ, বিলুপ্তপ্রায় এবং অনন্য উদ্ভিদ ও প্রাণীগুলো প্রভাবিত হবে
১৭। নদীর ময়লা শোধন ক্ষমতা হ্রাস পায়
১৮। ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, প্রত্নতাত্বিক ও ধর্মীয় সম্পদ জলমগ্ন হতে পারে (রাঙ্গামাটি-কাপ্তাই লেকে এমনই একটা ঘটনা আছে)
১৯। মানুষজন পূণর্বাসন এবং প্রতিস্থাপন (এবং জীবন যাপন পদ্ধতির সাম্ভাব্য পরিবর্তন)
২০। নির্মান শ্রমিকের আগমন ঘটে এবং তৎসংক্রান্ত সামাজিক, অবকাঠামোগত এবং স্বাস্থ্যগত প্রভাব পড়ে
২১। জলাধারের আশেপাশে পর্যটন বৃদ্ধি পায়
২২। ভাটিতে প্রচলিত কৃষি ব্যবস্থায় প্রভাব; বন্যা না হওয়ার কারণে ভাটির জমিতে উর্বরতা সরবরাহ হ্রাস পায়
২৩। জলাধারের জলসিঞ্চন উৎস-ভূমিতে (যে অঞ্চলে পতিত বৃষ্টির পানি এই জলাধারে নিষ্কাষিত হয়: বেসিন বা ক্যাচমেন্ট) রাস্তা ও অন্যান্য উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে বৃষ্টির পানির সাথে অতিরিক্ত পলি ও পুষ্টিদ্রব্য জলাধারে এসে পড়ে
২৪। পলিমুক্ত পানি প্রবাহের ফলে ভাটির নদীর ভূমিক্ষয়ের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়
২৫। সারা বছর সুষম পানি নিষ্কাশনের ফলে ভাটির জলাভূমি তথা হাওড়গুলোর স্বাভাবিক/ঋতূভিত্তিক পানি চক্র নির্ভর বাস্তুতন্ত্র বিলীন হয় (টিপাইমুখ চালু হলে আমাদের হাওড়গুলোর বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস হতে পারে)
== দ্রষ্টব্য ==
* ছবিটি উইকিপিডিয়া থেকে নেয়া: তাইওয়ানের JungHua বাঁধ এবং লেকের ছবি
* নিজেদের চিন্তাভাবনার সীমানা বৃদ্ধি করার জন্য লেখা