টপিকঃ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গবেষণার ভূমিকা -২
নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গবেষণার ভূমিকা এবং কৃতবিদ্য প্রবাসীদের সম্পৃক্ততা -২
যদি আমরা আগামী এক দশকে আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ভারতের সমতুল্য পরিমানে গবেষণায় ব্যয় করতে চাই (জিডিপির ০.৯%), আমদের বার্ষিক গবেষনার বাজেট হতে হবে এক লক্ষ কোটি টাকা (১১০ কোটি মার্কিন ডলার)। ২০১২ সালের জিডিপির ভিত্তিতে এটা নিরূপণ করা হলো (যা ছিল ১১৬০০ কোটি মার্কিন ডলার)। অত্যন্ত দুঃখজনক সত্য হলো আমরা বর্তমানে জিডিপির ০.০২% ভাগেরও কম খরচ করছি গবেষণায়। লক্ষ করুন ইথীয়পিয়াও আমাদের চেয়েও দশগুণ বেশী গবেষণায় ব্যয় করছে। পশ্চিমের সাথে যদি তুলনা করতে যাই - শুধুমাত্র একটি বিশ্ববিদ্যালয ক্যাম্পাস, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফর্নিয়া ডেভিসের (আমার কর্মক্ষেত্র ) গবেষনার বাজেটও BCSIR বাজেটের ছয় গুনের বেশি ছিল ২০১২-১২ সালে। ডক্টর জাফর ইকবাল ঠিকই বলছেন, ‘শিক্ষা এবং গবেষণার জন্যে সরকার যে পরিমাণ টাকা খরচ করে সেটা একটা কৌতুকের মতো!’
২০২৩ সাল নাগাদ অর্থাৎ আগামী দশ বছরের মধ্যে আমরা যদি জিডিপির ১% (২০১৩ সালের বাজেটের হিসেবে এক লক্ষ কোটি টাকা) খরচ করার পরিকল্পনা করি, সে টাকা দিয়ে কি করবে আমদের গবেষকরা? এত উচ্চমানের গবেষক আর গবেষণাগার কোথায় পাব আমরা? কোন ক্ষেত্রগুলোতে আমরা সম্পদ বরাদ্দ করব? কিভাবে আমরা এই ধরনের একটি বড় উদ্যোগ পরিচালনা করব? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুজতে চেনা ছকের বাইরে গিয়ে ভাবতে হবে। জাতীয় পর্যায়ে অভ্যন্তরীণ বিজ্ঞানী, গবেষক এবং ব্যবস্থাপকদের মাঝে আলোচনা প্রয়োজন; নির্বাচনী ইশতিহারে, প্রচার মাধমে, সংসদে আর পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি প্রয়োজন; সারা পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন দেশ কোন বিষয়গুলোতে মনোযোগ দিচ্ছে, তার সাথে আমাদের দেশের কোন সমস্যাগুলো সবচয়ে জরুরি, সেগুলো সনাক্ত করা প্রয়োজন। উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের কৃতবিদ্য প্রবাসীদের সহায়তা এক্ষেত্রে সুচারুভাবে কাজে লাগাচ্ছে। জাতিসঙ্গের প্রবাসী নাগরিকদের মাধ্যমে জ্ঞান হস্তান্তরের একটি প্রোগ্রামও (TOKTEN) আছে।
গবেষণা বিষয়ক দির্ঘমিয়াদী পরিকল্পনা, রুপায়ণের পন্থা আর ক্ষেত্রগুলো সনাক্ত করতে তুরস্কের প্রশাসন যোগ্য প্রবাসীদের এক বছরের মাইনে আগাম দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এখন দেশে আহ্বান করছে। এমনকি যদি প্রবাসীরা দেশে এসে একটি কাজ খুঁজে পূর্ণ মাইনেও পেতে থাকেন, তবুও তাদের জীবনের এই আকস্মিক পরিবর্তনকে গ্রহণযোগ্য এবং সহজসাধ্য করতে তুর্কী সরকার প্রতিশ্রুত অর্থ তাদের প্রদান করে যান। নিজ দেশের এই অনুকূল আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে পশ্চিম থেকে তুর্কী গবেষক আর বুদ্ধিজীবিদের এক বড় অংশ এখন ফিরে যাচ্ছে নিজ মাতৃভূমিতে। একসময় তরুণ বয়সে এরাই তুরস্ক ছেড়েছিল স্বার্থান্বেষী রাজনীতিবিদদের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে। ভারত গত তিন দশক ধরে প্রবাসী কর্মদক্ষ জনশক্তি আর বিশেষজ্ঞদের দেশে আমন্ত্রণ জানিয়েছে এবং বাপকভাবে উপকৃত হয়েছে। ভারতের এক বিশাল প্রবাসী জনগোষ্ঠী দেশে ফেরত গিয়েছেন বিত্ত, শিক্ষা, গভীর বিজ্ঞান, প্রযুক্তির আর ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা নিয়ে। মাহাথিরের শাসনামলে তিনি নিজে টেলিফোন করে অনেক যোগ্য প্রবাসীদের মালয়েশিয়ায় ফেরৎ নিয়ে এসেছেন। চীনা নেতারা আধুনিকীকরণ প্রকল্পের জাতীয় নীতিতে সম্প্রতি এক মাইলফলক ঘটনা যুক্ত করেছেন। এটা হলো এক হাজার প্রতিভাবান গবেষককে দেশে নিয়ে আসার প্রকল্প। এই কার্যক্রম চীন অথবা যেকোনো পটভূমির গবেষকদের জন্য উম্মুক্ত। প্রতিটি গবেষককে ১০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থ দিয়ে তাদের পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষনাগার খোলার সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। লক্ষ্য একটাই - চীনের গবেষনার মান দ্রুতগতিতে পশ্চিমের পর্যায়ে নিয়ে আশা।
প্রতিটি প্রবাসী সব সময়ই নিজের দেশে মাটিতে ফিরে আসার, দেশের ঋণ শোধ করার জন্যে সুযোগ খুঁজে, সে যে দেশেরই হোক না কেন। বেশিরভাগ বাংলাদেশীই পৃথিবীর অন্য জাতির তুলনায় দেশকে নিয়ে বেশি ভাবেন, সবসময়ই কিছু করতে চান। তাদের শক্তি আর মেধাকে কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজন যুক্তিসঙ্গত পথনির্দেশনা, সুযোগ্য নেতৃত্ব আর পরিকল্পনা। “এই দেশের উৎসাহী ছেলেমেয়েরা প্রতি বছর বাইরে পিএইচ-ডি করতে যায়। এদের অনেকে এত উৎসাহী, এত সৃজনশীল, এত প্রতিভাবান যে তাদের একটা ছোট অংশও যদি দেশে ফিরে আসত তাহলে দেশে মোটামুটি একটা বিপ্লব ঘটে যেত” – এটা আমাদের অনেকের মতই অধ্যাপক জাফর ইকবালের বিশ্বাস। যারা আজ পিএইচডি করতে কোরিয়া, মালেশিয়া, চীন, সিঙ্গাপুর, ভারত এবং অন্যান্য দেশে যাচ্ছেন, তারা এদেশে বসেই, এদেশের সমস্যার উপরে পিএইচডি করেতে পারতেন, যদি আমরা গবেষনাযন্ত্রটিকে সচল রাখতে পারতাম। এক সময় এশিয়ার অনেক দেশ থেকে আমদের দেশে ছাত্ররা আসত পড়াশোনা করতে। আজ আমরা অন্যদের তুলনায় একটি বিপরীত প্রবণতা অনুসরণ করছি।
রাজনীতিবিদ, পরিকল্পনাবিদ আর বিজ্ঞানীরা গবেষণানির্ভর অর্থনীতি ভিত্তিপত্তনে উদ্যোক্তা আর অগ্রদূতের ভুমিকা পালন করতে পারেন। এর বাইরে আর কাদের অংশ গ্রহনের কেঁদ্রীয় দায়িত্ব এবং ভূমিকা আছে? গার্মেন্টসের নারীরা, প্রবাসী শ্রমজীবী এবং কৃষকরা তাদের যা ছিল দেশকে উজার করে দিয়েছে। নিম্নবিত্তের স্বল্পশিক্ষিত এই তিন পেশার মানুষদের এর চেয়ে বেশী দেশকে দেবার মত কিছু নেই। মূলত জীবন যুদ্ধে তারা এত বেশী প্রলিপ্ত যে তাদের সময় নেই ভালো খারাপ বিবেচনার - সেটা রাজনীতি হোক, প্রযুক্তিনীতি হোক, অর্থনীতি অথবা সমাজনীতি হোক। জীবিকার তাড়না, পরিবার-পরিজন, সন্তান-সন্ততির ভবিষৎ আর জীবনের নিরাপত্তায় তারা দিবানিশি বাস্ত থাকেন । যে মধ্যবিত্ত শ্রেণী আমদের দেশে এক শক্তিশালী অর্থনীতি এবং সুস্থ্য রাজনীতির জন্ম দিতে পারতো, সেটার একটা বড় অংশ সবসময় সুযোগ খুজছে ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়ায়, কানাডায় আর আমেরিকায় চলে যাবার জন্য। তাদের হাতে আমরা প্রয়োজনীয় উন্নয়নের হাতিয়ার, আধুনিক প্রশিক্ষণ অথবা অনুদান দিতে পারছি না। শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব মেধাবী শিক্ষকরা, প্রভাষকরা আর প্রবল কর্মশক্তিপূর্ণ তরুণ তরুনীরা দেশের গবেষনাগারে আগামী দিনের বাংলাদেশের প্রতিচিত্র তৈরী করতে পারত, রাষ্ট্রীয় ক্ষুদ্র ব্যবসা-অনুদান নিয়ে জগৎবিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি গড়তে পারত, তারা হয়ত শুধু জীবিকা সংগ্রহের জন্য অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে গিয়ে শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত অসহনীয় ট্রাফিকে দিনাতিপাত করে অথবা কনসালট্যান্ট হিসেবে নিজেদের মেধার অনাকাংখিত অপচয়ে লিপ্ত হচ্ছেন। গবেষণাই এদের জীবিকার প্রধান উৎস হতে পারত। তাতে তাদের সৃজনশীলতা আর প্রতিভা দেশকে শতগুনে আলোকিত করতে পারত, অর্থনীতিতে লক্ষ-কোটিগুনে প্রভাব ফেলতে পারত।
দেশ নিয়ে হতাশা আর পথনির্দেশনার অভাবে একসময় বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, ইরান আর ইন্দোনেশিয়ার বিশাল জনগোষ্ঠি বৈধ-অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন বিপদাশঙ্কাপূর্ণ হারে। আজ এসব দেশের বেশিরভাগ তরুনরাই নিজের দেশে ফিরে আসার সুযোগ আর অনুকূল পরিবেশ দেখতে পাচ্ছে -আমরা ছাড়া। আমি ছাত্রাবস্থায় দেখেছি - অবৈধভাবে যাওয়ার পথে আমাদের দেশী যুবকেরা গ্রীক-তুর্কী সীমান্তে বরফ-ঢাকা নদীতে জীবন হারাচ্ছেন, পুলিশের আতঙ্কে অপরিচিত বিদেশী বন-জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে পশুদের আক্রমনের শিকার হচ্ছেন। যারা কোনোভাবে অনুপ্রবেশ করতে পেরেছেন, বছরের পর বছর অবৈধভাবে পরদেশে মানবেতরভাবে নিজেদের শ্রম সস্তায় বিক্রি করছেন। এদের অনেকেই উচ্চ-শিক্ষিত এবং পরিশ্রমী সুনাগরিক হতে পারতেন। গবেষনা ভিত্তিক অর্থনীতিতে এরাই হতেন কারিগর, নির্মাতা, কারখানার শ্রমিক, বহুজাতিক কোম্পানির কর্মচারী। মধ্য বয়সে দেশ ছেড়ে অনেকে শিক্ষিত বাংলাদেশী নিজেকে বিদেশের মাটিতে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হযেছেন। এ অনাকাঙ্ক্ষিত সম্ভাবনা মাথায় থাকা সত্বেও অনেকে দেশ ছাড়েন তাদের সন্তানদের ভবিষৎ চিন্তা করে। অথচ একবিংশ শতাব্দীতে বেশিরভাগ উন্নয়নশীল দেশে ঠিক তার উল্টো প্রবণতা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। আমরা যদি আমাদের জনশক্তির উন্নয়ন আর সদ্ব্যবহার নিয়ে উদাসীন থাকি, আজকের ‘গ্লোবাল ভিলেজে’ আমাদের সবচেয়ে যোগ্য মানুষগুলোকে সাদরে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য অনেক দেশই আগ্রহ দেখাবে। যেভাবে অস্ট্রেলিয়া আর কানাডা এই সুযোগ নিচ্ছে এখন।আমরা তার বিপরীত প্রবণতাও সৃষ্টি করতে পারি। মাহাথিরের শাসনামলে নিজে টেলিফোন করে যোগ্য প্রবাসীদের মালয়েশিয়ায় ফেরৎ নিয়ে আসার যে প্রবণতা তিনি সৃষ্টি করে গেছেন, আজকের অর্থনৈতিক উন্নতি তারই ধারাবাহিকতা বললে অত্যুক্তি হবে না।
নাসিরুদ্দিন হোজ্জাকে একবার জিগ্যেস করা হয়েছিল, ‘সকালে ঘুম থেকে উঠে মানুষেরা কেন একেকজন একেকদিকে যায়। কেউ যায় ব্যবসা-বাণিজ্যে, কেউ চাকরিতে, কেউ অফিস-আদালতে, কেউ স্কুল-কলেজে।’ প্রশ্ন শুনে হোজ্জা হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘সবাই একদিকে গেলে পৃথিবীটা কাত হয় যাবে যে।’ আমাদের দেশের সবচেয়ে যোগ্যতাবান আর ভাগ্যবানরা নিজের ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। যারা থেকে যাচ্ছেন তারাও অসুস্থ্য রাজনীতির যাতাকলে পিষ্ঠ হয়ে বেচে থাকার সংগ্রামে জীবনপাত করে চলেছেন। খুব অল্প সংখ্যক প্রবাসীই আজ দেশে ফিরে আসেন। অনেকেই এসে বছর না পুরুতেই আবার ফিরে যাচ্ছেন প্রবাসে । এই একমুখী জনশক্তির প্রবাহ আমাদের দেশকে নিঃসন্দেহে কাত করে দিয়েছে। সমাজে গবেষণার প্রসার এ বিনাশী প্রবণতাকে থামিয়ে দিতে পারে।
একজন প্রতিভাবান গবেষক শুধু আজকের বাংলাদেশের কলুষিত রাজনীতি আর নেতৃত্ব থেকেই দূরে থাকবেননা, তিনি রাজনীতিবিদদের সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়ার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থাটা এড়াতে চাইবেন। আমাদের নবীন প্রজেন্মের প্রায় ৪০ লক্ষ ফেইসবুক ব্যবহারকারীদের একটা বড় অংশের রাজনীতিবিদদের জন্য সামান্যতম শ্রদ্ধাও নেই। এরা কেউই হয়তবা বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট হবেন না। মেধাবী গবেষকদের রাজনীতিতে অনাসক্তি শুধুমাত্র আমাদের দেশেরই সমস্যা নয় - যেখানে মানুষের জীবন ও ক্ষমতার ওপর সরকারি দলের থাকে একচেটিয়া কদর্য প্রভুত্ব এবং বিরোধী দলকে থাকতে হয় পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হওয়ার আশঙ্কায় নিমজ্জিত হয়ে। এটা কমবেশি সবগুলো তৃতীয় বিশ্বের দেশেরই একটা সর্বজনীন সমসা। স্বপ্নদর্শী রাজনৈতিক নেতারা একারণে গবেষনার কার্যক্রম সম্পূর্ণ রাজনীতি-নিরপেক্ষ নাগরিকদের আমন্ত্রণ জানান গবেষণার কর্মপ্রচেষ্টাকে নেতৃত্ব দেয়া এবং পরিচালনার জন্য। ওবামা জ্বালানি মন্ত্রনালয়ে একারণে একজন নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানি স্টিভেন চু কে নিয়োগ করেছেন দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যার বৈজ্ঞানিক সমাধান মোকাবিলায়। তার নেতৃত্বে প্রায় অর্ধ ট্রিলিয়ন ডলার (৫০ হাজার কোটি ডলার) আমেরিকায় জ্বালানি খাতে প্রযুক্তি উন্নয়নে ব্যয় করেছে। এতবড় কার্যক্রম পরিচালনার পূর্বে কেউ তাকে রাজনীতিতে দেখেনি। তিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালযের বার্কলে ক্যাম্পাসে একটি জাতীয় গবেষণাগারের (লরেন্স বার্কলে ন্যাশনাল ল্যাব) পরিচালক হিসেবে গবেষণায় সক্রিয় ছিলেন।
চার চাকার একটা গাড়ি যদি আমরা তৈরী করতেও পারি, সেই গাড়ির চালক অসহায় বোধ করবে যদি গাড়িটিতে তেল, পানি, লুব্রিক্যান্ট, ইত্যাদি পরিমিত পরিমানে সরবরাহ না করা হয়। গাড়িটিতে যদি একটি রাজনৈতিক দলের নাম লেখা থাকে তবে অন্য দলগুলো সুযোগ পেলেই সেটাকে বিকল করে দেবে, জানালা দরজা ভেঙ্গে দেবে, সেটার গায়ে আগুন ছুড়ে মারবে - যা আমাদের দেশে গত দুই দশক ধরে আমরা দেখেছি। রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট অথবা জড়িত একজন চালকের কার্যক্রম ক্ষমতাসীন দলগুলোর রাজনৈতিক অবস্থানের জন্য হয়ত সুবিধাজনক বা সমর্থনসূচক হবে, দেশের জন্য হিতকর নাও হতে পারে । একবার তাদের কার্যকলাপ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তাদের সমস্ত ভালো কাজের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সেকারণে দরকার একটি দল-নিরপেক্ষ জাতীয় নীতি, যাতে সর্বোচ্চ পর্যায়ের পৃষ্ঠপোষকতা থাকবে, যা রাজনীতিবিদরা হীন স্বার্থের জন্য অপব্যবহার করবে না। এটি একটি কঠিন সমস্যা কিন্তু এর সমাধান নিশ্চয়ই সম্ভবপর।
পরিশেষে আসন্ন নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে কিভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক হিসেবে গবেষণা ভূমিকা রাখতে পারে সেটা পর্যালোচনা করা যাক। সুশিক্ষিত রাজনীতিবিদদের এবিষয়ে খুব বেশি বলতে হবে না। উন্নত দেশগুলোর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলোকে, অনলাইনে সহজলভ্য নানাদেশের বিজ্ঞান, শিল্প, জ্বালানি, পরিবেশ, পানিসম্পদ, শিক্ষা, প্রযুক্তি এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালযের স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনাগুলো, তাদের নেতৃত্ব আর কর্মীবাহিনীর শিক্ষাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, সাফল্য, ব্যর্থতা আর সুপারিশমালা তারা দেখতে পারেন। আমেরিকার ন্যাশনাল একাডেমি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং এ শতাব্দীর জন্য ১৪ টি দুর্দান্ত চ্যালেঞ্জ সনাক্ত করেছে যেগুলোর বেশিরভাগ সারা পৃথিবীর সবগুলো দেশের জন্যই প্রাসঙ্গিক।
আজকের প্রজন্ম আর আমাদের শিক্ষিত সমাজ ভবিষ্যৎ পৃথিবীর সম্পর্কে অপরিজ্ঞাত নয়। তারা জানে তাদের উচ্চতর ডিগ্রী, মজবুত পড়াশোনার ভিত্তি আর অর্জিত অভিজ্ঞতা কাজে লাগাবার মত কাজ এদেশে খুব নগণ্য সংখ্যকই আছে। বর্তমান অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তিগুলো অর্থাৎ গার্মেন্টস, বিদেশে শ্রমবিক্রি এবং কৃষিকাজ শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে আকৃষ্ট করে না। বেশিরভাগ দেশে উন্নয়নের সাথে সাথে সামগ্রিকভাবে এই খাতগুলোর ভুমিকা ক্রমাগত কমে এসেছে। তার জায়গায় প্রযুক্তি নির্ভর, মেধা সম্পত্তি এবং প্রশিক্ষণ ভিত্তিক বেশি আয়ের কাজের পরিমান বেড়েছে।
আশেপাশে চোখ খুললেই আমরা দেখি প্রকৌশলে স্নাতক ডিগ্রী শেষ করে, এমনকি ব্যবস্থাপনায় মাস্টার্স করেও সামান্য বেতনে কাজ করছে উৎসাহী এবং প্রতিভাবান যুব সম্প্রদায়ের এক বিশাল অংশ। পুরো পরিবারের সবাই কাজ করলেও এধরনের আয় জীবন যাপনের জন্য খুবই অপ্রতুল। একজন কৃষক বা গার্মেন্টসের শ্রমিক তাদের সন্তানদের বহুকষ্টে পড়াশোনার যোগান দিয়েও দেখছে যে তাদের শিক্ষিত সন্তানদের উপার্জন তাদের চেয়ে খুব বেশি নয়। এই উপলব্ধি নিয়ে প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী বিদেশে শ্রমবিক্রি করতে যায়। পরিনামে আমরা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছি আর আমাদের নেতারা এর জন্য কৃতিত্ব নিতে ভুল করছেন না।
নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে একটি শক্তিশালী গবেষণার নীতিমালার অন্তর্ভুক্তি সমাজের প্রতিটি মানুষের মনে নিশ্চিতভাবে আশার আলো জ্বালাবে। সমাজের প্রতিটি মানুষ আজ বুঝে যে সারা পৃথিবীর শ্রমিকরা যে কাজগুলোকে কম মুজুরির কারনে বর্জন করছে, সেগুলো দিয়ে শিক্ষিত জনগোষ্টিকে উদ্দীপিত করা যাবে না। একবিংশ শতকে একটি দেশের বিস্ময়কর অর্থনৈতিক উন্নয়ন শুধু বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ভিত্তির উপরেই গড়া সম্ভব হতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন গবেষণা, সুস্পষ্ট গবেষনার নীতিমালা, ক্ষুদ্র এবং মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সৃষ্টিতে অর্থনৈতিক অনুদান এবং উদার তহবিল। রাজনৈতিক দলগুলো এবার পরীক্ষামূলকভাবে আসন্ন নির্বাচনী অভিযানে গবেষণাভিত্তিক অর্থনীতি এবং সমাজ গড়ার একটি স্বচ্ছ পরিকল্পনার অঙ্গীকার করে দেখতে পারে। এ ধরনের অঙ্গীকার নিশ্চিতভাবেই শিক্ষিত যুব সমাজকে গভীরভাবে অনুপ্রানিত করবে। দেশ আর দেশের মানুষের জন্য কাজ করার আন্তরিক ইচ্ছা থাকলে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির তালিকায় গবেষণায় বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি মানুষ দেখতে চায়। প্রযুক্তি-নির্ভর উদ্দীপিত অর্থনীতি যুবসমাজকে আধুনিক জীবনের ধ্বংসাত্মক প্রবণতাগুলো হতে ফিরিয়ে আনবে। নিজের জীবন এবং সমাজ গড়ায় তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করবে।
আগামী পাঁচ বছরে ক্রমান্নয়ে বাড়িয়ে জিডিপির ১% এবং দশ বছরে ৩% পর্যন্ত গবেষণায় বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি আর তার সফল বাস্তবায়ন আমাদের সৃষ্টিশীল এবং কঠোর পরিশ্রমী মানুষের দেশটিকে অর্থনৈতিকভাবে একটি প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বশক্তিতে রূপান্তরিত করবে। একদিন হয়ত আমাদের দেশেও রাজনীতিবিদরা গবেষণায় কে কত বেশি অর্থ অনুমোদন করেছেন তা নিয়ে গর্ববোধ করবেন।