টপিকঃ আধ ডজন স্কুল, একটা ফাউ!
দীপু নাম্বার টু স্টাইলে আমার শৈশব কেটেছে। আব্বার ট্রান্সফারের চাকুরির সুবাদে। চট্টগ্রামের মিরসরাই ও সাহেরখালি, গাজীপুরের কাপাসিয়া, সিলেটের আম্বরখানা ও সাগরদীঘির পাড়, সুনামগঞ্জের ছাতক, ময়মনসিংহের চরপাড়া, ঢাকার পীরেরবাগ ও মনিপুর, এরপরে সাভার।
পরীক্ষায় মোটামুটি ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড হলেও রোল সবসময় ৫০, ৫৫, ৬৪ এর ঘরেই থাকত। সাভারে আসার পরে সেই কুফা কাটল। এবার রোল নম্বর বিশাল হাইপার ডাইভ দিয়ে এক লাফে ১৭, কারণ আমি আসার আগে ক্লাসে ছিল ১৬ জন। নতুন স্কুলে যাবার পরেই স্যাররা জিজ্ঞাসা করতেন, আগের স্কুলে রোল কত ছিল? উত্তর শুনেই স্যাররা এমনকি বেড়াতে আসা আঙ্কেল আন্টিরাও ধরে নিতেন এই ছেলে বিরাট বদমাইশ, পড়ালেখা করে না।
সাভারে আসার পর আব্বা আবার টাঙ্গাইল ও পরে রংপুরে ট্রান্সফার হলেও আমরা সাভারে থেকে গেলাম। পুরনো স্কুল ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত হওয়ায় আবারো স্কুল বদলে ভর্তি হলাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলে এবং এবারো রোল ৫০। ক্লাসের প্রথম দিকে থাকা ক্লাস ক্যাপ্টেন এবং ভাল ছাত্রদের সাথে আর মেশা হল না খুব একটা। ওরা ক্যাপ্টেন হয়, ছেলেদের ক্যাপ্টেন আদনান আর মেয়েদের ক্যাপ্টেন সুমাইয়া, এরা দুইজন ক্লাসে কেউ কথা বললেই বোর্ডে নাম লিখে স্যারের কাছে জমা দিয়ে মার খাওয়ায় আর ক্লাসে গল্পের বই নিয়ে গেলেই ওরা সিজ করে স্যারের কাছে জমা দেয়। তিন গোয়েন্দার ভলিউম ৫ (কাকাতুয়া রহস্য, ছুটি, ভুতের হাসি) বইটা পরপর দুইবার সিজ হয়েছিল আমার। এমনকি যারা যারা টিফিন টাইমে ভিডিও গেম খেলতে সাভার ক্যান্টনমেন্টের স্টেশন ক্লাবে যেত, তাদের নামগুলোও সুন্দর করে স্যারের কাছে বলে দিত। আকতার স্যার, আর মির্জা ম্যাডাম নামে দুইজন ভয়ংকর মানুষ ছিলে স্কুলের ত্রাস, এই জাতীয় ক্রাইম গুলা উনারা নিজেরা হ্যান্ডেল করতেন।
ভাল ছাত্ররা টিফিন টাইমে লক্ষী ছেলের মত টিফিন খেত, ভিডিও গেম খেলার জন্য স্টেশন ক্লাবে যেত না, এমনকি ওরা লুকিয়ে চন্দ্রিমা হলে টাইটানিক দেখতেও যেত না। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার সময় রোদের মাঝে প্যারেড করত ডান বাম ডান বাম। আর আমরা খারাপ যারা, তারা স্কুল পালিয়ে সোজা স্টেশন ক্লাবে, কিংবা দেয়াল টপকে সোজা স্কুলের বাইরে স্টেশন ক্লাবে।
একবার সিরাজুল ইসলাম স্যার ক্লাসে জিজ্ঞাসা করছিলেন বড় হয়ে কে কি হতে চাও। সবাই ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার পাইলট হতে চাইলেও খারাপ ছাত্র একজন ফট করে বলে উঠল, সাইনটিশ হইতে চাই স্যার। স্যার জিজ্ঞাসা করলেন, বিজ্ঞানে কত পাইছিস তুই লাস্ট পরীক্ষায়? বাকি ঘটনা মনে নাই।
খারাপ হবার সুবাদেই কিছু অসাম বন্ধুদের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠল।
যারা টিফিন টাইমে মেয়েদের সাথে খেলে তারা হাফ লেডিস। তাদের সাথেও মেশা যাবে না, সুতরাং খারাপ ছেলে সাবরী, খারাপ ছেলে নাঈম, খারাপ ছেলে তপু, খারাপ ছেলে পান্না, হাসান, অপু, খারাপ ছেলে জসীম, শিশির, ভূঁইয়া, আরিফ, তৌহিদ, রানা এদের সাথে মোটামুটি ভাল সম্পর্ক হয়ে গেল।
ওদের কাছ থেকে শিখলাম, মোস্তফা গেমে কোন বসকে কোথায় বাটে ধরতে হয়, কেউ লাইফ খেতে না দিলে কিভাবে টাইম ওভার করতে হয়, তিন ব্লেড বসকে কিভাবে একাই বাটে ধরা যায়, স্ট্রিট ফাইটার গেমে কিভাবে আদুকেট (hadouken) মারতে হয়, ডাবল ড্রাগন গেমে চ্যাংফু নেয়া ভাল নাকি রেবেকা?
ওদের কাছেই শিখলাম স্কুল ছুটির পরে ঠেলাঠেলি করে বাসে উঠার চেয়ে বাসের পেছনের মই বেয়ে ছাদে উঠে যাওয়াটা ভাল, মাঝে মাঝে ভাড়াও দিতে হয় না, আর সেইরকম বাতাসে ব্যাপক আরাম লাগে।
ক্লাস সেভেনে উঠেই সেই খারাপ ছাত্রদের দল থেকে কিভাবে যেন আলাদা হয়ে যেতে লাগলাম। রোল নম্বর চার। স্যার ম্যাডামরাও মাত্র চেহারা চিনে ফেলা শুরু করল। স্টেশন ক্লাবে গেলে দূর থেকে দেখে চিনে ফেলে, স্কুল পালালে টিফিনের পরের পিরিয়ডে খুঁজে না পেয়ে পরের দিন পিটনি খেতে হয়, বাসের ছাদে উঠলেও চিনে ফেলে, পরের দিন অ্যাসেম্বলীতে পিটায়। বিরাট দিগদারী!
এবার আর স্কুল বদলাবারও সুযোগ নেই, কারণ সাভারে নিজেদের বাড়ি এবং আব্বার পোস্টিং এবার সাভারেই!
কি আর করা! এমনিতেই স্কুলের পড়ার চোটে বিকালে খেলতে যাওয়ার সময় কম পাই। সবাই যখন সাড়ে চারটা বাজতেই মাঠে, আমি তখন সাড়ে পাঁচটার পর মাঠে গিয়ে দেখি খেলা শুরু হয়ে গেছে! আমাকে কেউ খেলায় নেয় না শেষ ভরসা আবার সেই ভিডিও গেমের দোকান! জীবনে কত টাকা যে এই মোস্তফা গেমের পিছনে নষ্ট করেছি তার কোনই হিসেব নাই।
এর মাঝে আব্বা আবার এক্সট্রা প্রেশার দেয়া শুরু করল ক্যাডেট কলেজে ভর্তির জন্য পড়ালেখা। ক্লাস সিক্সে বার্ষিক পরীক্ষার পর যখন সবার অফুরন্ত অবসর, তখন আমাকে দৌড়াতে হত ঢাকায় প্রচেষ্টা ক্যাডেট কোচিঙে, যার সাথে আবার গুরুগৃহ নামের কোচিং এর সেই রকম ক্ল্যাশ!
আমার অবশ্য ভালই লাগত, ক্লাস সিক্সে থাকা অবস্থায় একা একা বাসে করে ঢাকা যাওয়া মানে আমি বড় হয়ে গেছি ... সে এক অন্যরকম অনুভূতি! মাঝে মাঝেই কোচিং পালিয়ে সংসদ ভবন, চন্দ্রিমা উদ্যানে একা একা ঘোরা, সংসদ ভবনের লাল ইটের ওপর বসে বসে গল্পের বই পড়া, মাঝে মাঝে শ্যামলী সিনেমা হলে ইংরেজী সিনেমা দেখা... লাইফ ওয়াজ গুড...
কোচিঙেও ঝামেলা শুরু হল যখন আমার আব্বার খালাত ভাই হেলাল কাকা টিচার হয়ে এলেন, এবার শুরু হল পেইন, একটা দিন না গেলেই, একটা পরীক্ষায় একটু কম পেলেই আম্মার কাছে কমপ্লেইন ... কোচিঙে অবশ্য ভাল ছেলেদের সংখ্যাই বেশি, সাভারের আরো দুইটা ছেলের সাথে পরিচয় হইল, একজনের নাম রঞ্জন, ওরে অবশ্য ওর মা প্রতিদিন নিয়ে আসত আবার নিয়ে যেত। আরেকজনের নাম জাকারিয়া, হাতের লেখা ব্যাপক সুন্দর, সে আর আমি একসাথে আসতাম।
ঢাকার আরেকটা ছেলে ছিল (নাম মনে নাই), সেইরকম বদ, যাকে প্রতিদিন নতুন নতুন গাড়িতে করে দিয়ে যেত ওর বাসা থেকে। ওদের নাকি তিনটা গাড়ি! আরেকটা মেয়ে ছিল কথা বলত না বেশি, কিন্তু পরীক্ষায় ফাটাত। অনিন্দ্য সাহা নামের আরেকটা ছেলে ছিল কোচিং এর লিজেন্ড! কোচিং এর ডিরেক্টর আফলাতুন স্যার প্রতিমুহূর্তে তার নাম জপতেন। সম্ভবত রেসিডেন্সিয়াল মডেলের, যে সব কিছু পারত, ভয়েস চেঞ্জ, ন্যারেশন ছাড়াও কে কত সালে কিসে নোবেল পাইছে থেকে শুরু করে কোন বিশ্বযুদ্ধ কত সালে শুরু হইছে, কবে শেষ হইছে সব জানে, চোখের নিমিষে লসাগু গসাগু করে ফেলে! কিরেব্বাই!
হেলাল কাকা একদিন খুব পেটালেন কোচিং এ আমাকে, আমি আগের দিন কোচিং এ না এসে কই গিয়েছিলাম জানার জন্য আর ব্যাগে তিন গোয়েন্দার বই পাওয়ায়। সেদিন বাসায় গিয়েই আমি সাফ জানিয়ে দিলাম, আমি আর কোচিং এ যাচ্ছি না। বাবা মা ছেড়ে ক্যাডেট কলেজের মত জায়গায় একা একা ছয় বছর থাকার কোন ইচ্ছেই নেই আমার। তাছাড়া ক্যাডেট কলেজে ভিডিও গেমের দোকানও নেই। আব্বা বোঝাতে চাইলেন যে ক্যাডেট কলেজের লাইব্রেরিতে অনেক গল্পের বই আছে, কিন্তু তবুও রাজি হলাম না। একমাত্র সন্তান হওয়ায় আম্মারও আমাকে ক্যাডেট কলেজে দেবার খুব বেশি ইচ্ছে ছিল না, তাছাড়া ডেইলি একমাত্র সন্তানকে কোচিং এর জন্য একা একা ঢাকা পাঠিয়ে উনি খুব দুশ্চিন্তায় থাকতেন।
শেষ পর্যন্ত আম্মা আমাকে বোঝালেন, ঠিক আছে কোচিং করে পরীক্ষাটা দাও, ক্যাডেটে যেতে হবে না। আমি মনে মনে "ওক্কে" বলে, আবার কোচিং শুরু করলাম। আব্বা ফর্ম আনলেন সিলেট ক্যাডেট কলেজের আর মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের। বললেন, কোনটায় ভর্তি হবা? আমি বললাম, আমি তো যাচ্ছি না। আব্বা হেসে বলল, আচ্ছা যেতে হবে না, কিন্তু যদি যেতেই হয়, তুমি কোনটায় যাবা? আমি বললাম, যেটায় বেশি গল্পের বই আছে। আব্বা দুই কলেজের প্রসপেক্টাস ঘাঁটা শুরু করলেন। মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ সিলেট ক্যাডেট কলেজকে বিশাল ব্যবধানে হারিয়ে জয়ী হল।
শহীদ আনোয়ারে রিটেন পরীক্ষা দিলাম, কি দিলাম আল্লাহ মালুম। কেমনে কেমনে টিকেও গেলাম। এবার আব্বা বলল, ভাইভাটা দাও শুধু যেতে হবে না ক্যাডেটে।
ক্যাডেট কলেজের ভাইভা মানে শুধু ভাইভা না, সাথে মেডিকেলও। দুই হাতে ইট নিয়ে ওঠবস যাতে হাঁটু লেগে না যায়, আর চোখ ৬/৬ আছে কি না সেটা টেস্ট করানো। বাই দা ওয়ে, ৬/৬ জিনিসটা কি আমি এখনো জানি না। কোচিং এ যাওয়া একরকম বাদই দিলাম। পালিয়ে পালিয়ে ঘুরে বেড়ানোর নেশায় পেয়েছিল আমাকে। শেষে কিছুদিন গিয়েছিলাম অবশ্য, ভাইভার মডেল টেস্ট টাইপ এক্সাম দিতে, যেখানে আফলাতুন স্যার, শাহ আলম স্যার ভাইভা নিতেন, আর বলতেন, এই ছেলেকে নিয়ে কোন আশা নাই ( হুদাই কইলাম, আশা নাই এইটা বলেন নাই কখনোই!)। তবে জাকারিয়া, অনিন্দ্য, কিংবা রেসিডেন্সিয়ালের ওই মেয়েটা, এরা ভাইভাতেও কুড়াল দিয়া কোপাইতো!
বিএএফ শাহীন কলেজ ঢাকায় ভাইভা ও মেডিক্যাল হবে। ভাইভা আর মেডিক্যাল টেস্ট একই দিনে হবে জানলেও, এই ভয়াবহ কথাটা আমি জানতাম না যে মেডিক্যালে প্যান্ট খুলতে হবে। এই ভয়ংকর কথাটা কেউ বলে নাই কেন? ভাইভার আগে মেডিক্যাল আগে হয়, এইটাও জানতাম না। আমার ইন্ডেক্স নম্বর ৫০০৫, সবার আগে! মোটামুটি যা যা পড়েছি সব মনে মনে জপতে জপতে ভাইভা দিতে গেলাম, দেখি আর্মির ড্রেস পড়া দাড়িওয়ালা বিশাল একজন মানুষ (নেমপ্লেটে লেখা ইদ্রিস, তখন চিনতাম না যে উনি আমাদের সবার প্রিয় ইদ্রিস স্টাফ) আমাকে ডেকে নিয়ে একটা রুমে ঢোকালেন। আর কাকে যেন বললেন, অ্যাই পরের সবগুলারে রেডি ডাক, ডাইকা রেডি কর! কালার ব্লাইন্ড টেস্ট, টিউনিং ফর্ক টেস্ট, জিহবা, চোখ, হাঁটু, প্রেশার ইত্যাদি সব টেস্ট শেষ করে বললেন প্যান্ট খোল! আমার আক্কেল গুড়ুম, কয় কি মমিন! বাকিটা নাই বা বললাম।
ভয়াবহ সেই অভিজ্ঞতা শেষ করে যখন বাইরে বের হলাম, দেখি পরবর্তী পরীক্ষার্থীদের অলরেডি সাদা গেঞ্জি আর সাদা আন্ডি পরিয়ে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। এরপরে ভাইভাই আমার হাত কাঁপছিল, কথা বলতে পারছিলাম না ঠিক মত, এতবড় সম্ভ্রমহানির পরে কিভাবে স্বাভাবিক থাকা যায়?
ভাইভার পরই আমার ভয়াবহ জ্বর এল। সাভার নিয়ে যাওয়া আর সম্ভব ছিল না সেই অবস্থায়, আমাকে নিয়ে যাওয়া হল খিলগাঁওয়ে আমার খালার বাসায়। আমার খালাত ভাই রনি আমার সাত দিনের বড়। খালাম্মার বাসা মানে আমার জন্য বেহেশত! খালাম্মার বাসায় গেলেই নতুন জামাকাপড় তো পেতামই, সেই সাথে ফিরে আসার সময় ব্যাপক মন খারাপ হত, খালু হাতে সবসময় কড়কড়ে ১০০ টাকার নোট গুঁজে দিয়ে বলতেন, বিস্কুট কিনে খেও। দুই কোলে দুইজনকে বসিয়ে খালাম্মা আমাকে আর রনিকে খাওয়াতেন, খালু আমাকে খুবই আদর করতেন, আর বড় দুই খালাত ভাই রাসেল ভাই আর বাবু ভাই, উনারা ছিলেন আমার রোল মডেল। রাসেল ভাই আর বাবু ভাই হাতের লেখাওয়ালা খাতা এনে আমি হাতের লেখা সুন্দর করা প্র্যাকটিস করতাম।
উনাদের বাসায় ডিশ কানেকশন ছিল, ৩৬ টা চ্যানেল, একটায় আবার সারাদিন কার্টুন হয়, জনি কোয়েস্ট, টম এন্ড জেরি যেগুলো বিটিভিতে সপ্তাহে মাত্র একবার দেখাতো, সেখানে এগুলো দেখায় প্রতিদিন, তাও আবার দুইবার করে! পপাই দা সেইলর ম্যানের সাথে আমার তখনই পরিচয়।
সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলে নতুন বছরের ক্লাস শুরু হয়ে গেছে অনেকদিন হল। সামনে প্রথম সাময়িক পরীক্ষা। সবাই সিরিয়াস। ক্যাডেট কলেজের ভর্তি পরীক্ষার কথা ভুলেই গেছি প্রায়, কারণ চান্স পেলেও আমি যাচ্ছি না, সেকথা বাসায় অলরেডি বলে দিয়েছি। কোন একদিন সেকেন্ড পিরিয়ডে আব্দুল্লাহ আল মামুন স্যার আমাকে, সাবরীকে আর আদনানকে (ফার্স্ট বয়!) ডেকে নিয়ে গেলেন। খারাপ ছেলে সাবরী আর আমি ভাবছি, শিওর ক্লাস ক্যাপ্টেন আদনান কোন কিছু নিয়া আমাদের নামে বিচার দিছে অথবা ফাঁসাইছে। স্যারের হাতে পেপার, সেটা দেখিয়ে বললেন, কি তোমরা মিষ্টি খাওয়াবা না? ক্যাডেটে চান্স পাইছ তোমরা। ব্যাক্কল হয়া গেলাম পুরা! কিরেব্বাই? সাবরী রাজশাহী ক্যাডেট কলেজে আর আদনান আর আমি মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে।
ক্লাসে আসার সাথে সাথে ক্লাসের স্যার জিজ্ঞাসা করলেন, কি ব্যাপার, কেন ডেকেছিল? বললাম, স্যার ক্যাডেটে টিকছি। স্যার সাথে সাথে সেইটা ক্লাসে অ্যানাউন্স করে দিলেন। মেয়েরা তাকাল আমাদের দিকে, ফার্স্ট বয় আদনান যে চান্স পাবে এতে ওরা কেউ অবাক হয় নি, কিন্তু সাবরী আর আমার মত খারাপ পোলাও? ক্যাডেট কলেজের স্ট্যান্ডার্ড খারাপ হয়ে গেছে শিওর!
এরপর বাসা থেকে আমাকে ক্যাডেট কলেজে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হল। আবার দীপু নাম্বার টু টাইপ ফিলিংস। এই অনুভূতির একটা বড় সমস্যা হল, বহুবার এই ফিলিংসের সামনা সামনি হলেও এতে কক্ষনো অভ্যস্ত হওয়া যায় না। বন্ধুদের ছেড়ে আসতে কি রকম খারাপ লাগে সেটা ক্লাস সিক্স পর্যন্ত ছয়টা স্কুলে পড়া আমার চেয়ে ভাল আর কে জানে?
জানে, দিপু নাম্বার টু জানে। টু ব্যাড হি ডাজন্ট এক্সিস্ট ইন রিয়ালিটি!
প্রথম সাময়িক পরীক্ষা দিতে হবে না, আর মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের লাইব্রেরীতে প্রচুর গল্পের বই আছে, শুধু এই দুটি কারণে আমি ক্যাডেট কলেজে যেতে রাজি হলাম। বাসা থেকে এবারও বলল, আপাতত যাও, প্রথম সাতদিন থেকে চলে এসো। ছয় বছর পড়তে হবে না।
এরপর শুরু হল খোঁজ নেয়া, কি কি কিনতে হবে। আর কে কে চান্স পেয়েছে ক্যাডেটে। একদিন আব্বা বললেন, আমাদের এলাকায় ক্যাপ্টেন সিকদার সাহেবের ছেলে রাব্বি গতবছর পাবনা ক্যাডেট কলেজে চান্স পেয়েছে। আরো জানলাম কোচিং থেকে অনিন্দ্য কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজে আর জাকারিয়া পাবনা ক্যাডেট কলেজে চান্স পেয়েছে।
১৯৯৯ সালের জুন মাসের ৩ তারিখ, বৃহস্পতিবার।
আরো ৫২টা অভাগা ছেলের সাথে ম.ক.ক. মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে (মতান্তরে মির্জাপুর কেন্দ্রীয় কারাগার) পা রাখলাম। ক্লাস এইটের একজন আমার এসকর্ট (অন্য ক্যাডেট কলেজে গাইড বলে) হলেন, উনি প্রথমেই বললেন, আমার নাম মঞ্জুর। আমার নাম কি? বললাম, মঞ্জুর। উনি বললেন, মঞ্জুর না, বল মঞ্জুর ভাই। আমি বললাম, মঞ্জুর ভাই। উনি এইবার আবারো জিজ্ঞাসা করলেন, বলতো আমার নাম কি? বললাম, মঞ্জুর ভাই। উনি বললাম, আমার নামে ভাই আছে? বললাম, জ্বী না। উনি বললেন, তাহলে ভাই বললা কেন? আমি কনফিউজড! নজরুল হাউজে আমরা ১৭ জন। ক্যাডেট নম্বর দেখেই আবার সেই পুরনো ফিলিংস, ২০০৩, শালার এইবার রোল নম্বর খারাপ হইবো, তাই বইলা হাজারের ঘরে? শিট ম্যান! মঞ্জুর ভাই আমাকে ক্যাডেট কলেজের নিয়ম কানুন শেখানোর আগেই যেটা শেখালেন, সেটা হল একটা রুম। রুমটার নাম, বারিশ। উনি বললেন, এই রুমটা চিনে রাখ। রুমটার নাম বারিশ। আমি সাথে সাথে রুমের ভিতরে তাকালাম। উনি সাথে সাথে বললেন, খবরদার কোন সিনিয়রের রুমের দিকে তাকাবা না, মাথা নিচু করে হাঁট। আমি মাথা নামালাম। উনি বললেন, এই রুম থেকে সাবধান থাকবা, এইরুমে রাজীব আহমেদ ভাই থাকেন। কোন ফল্ট করছ, তো গেছ, এক্কেবারে ছিঁড়ে ফেলবে উনি!
বিকেলে সবার বাবা মা চলে যাবার আগে রিফাত আর রেজওয়ানের সে কি কান্না! আমি মনে মনে হাসি, এই সাতদিন পরেই তো আমি আবার বাসায় ফিরে যাচ্ছি, এরপর আমি আর আসছি না, এই সাতদিন আমি শুধু গল্পের বই পড়ে কাটাব। ব্যাটা, তোরা এই জেলখানায় থাকবি ছয়ডা বচ্ছর, আর আমি থাকুম মাত্র ৭ দিন। খ্যাক খ্যাক! সন্ধ্যায় নজরুল হাউজের সাগরিকা রুমে আমরা ৯ জন বসে আছি, কারও সাথে এখনো কারো পরিচয় হয় নি। শুধু ইসলাম আর সাদী দুইজন দুইজনকে চিনে, ময়মনসিংহের বিখ্যাত দি ক্যাডেট কোচিং এর প্রোডাক্ট ওরা। কিন্তু ওরাও নিজেদের সাথে কথা বলছে না ভয়ে। শিওর ওদের এসকর্টরাও ওদের রাজীব আহমেদ ভাইয়ের কথা বলেছে।
হঠাৎ আমার পাশের বেডের ছেলেটার কাছে তার সামনের বেডের ছেলেটা এসে দাঁড়াল, জীবনে এরাও কেউ কাউকে কোনদিন দেখে নি।
নেমপ্লেট পড়ে দেখলাম, একজনের নাম আশেক, একজনের নাম আহসান।
আহসান আশেকের কাছে এসে দাঁড়ালে ভাবলাম, কি নাম, কই থেকে আসছে, এইসব জিজ্ঞাসা করবে। কিন্তু না , আহসান আশেককে যা বলল, তাহল, "আমি নারী বই পড়ছি!"
আশেক অবাক হয়ে বলল, "নারী বই? কি আছে নারী বইতে?"
আহসান ফিসফিস করে মুচকি মুচকি হেসে বলে, "ঐসব!!!"
আশেক বলে, "কোন সব? ... ছিঃ ঐসব? "
আহসান বলে, "হুম, ঐসব!!"
আমি পাশ থেকে শুনে হাসছিলাম। আহসান আমাকে বলে, "তুমিও ঐসব বুঝো?"
আমি বললাম, "ঐসব তো সবাই বুঝে!"
ব্যস, শুরু হয়ে গেল খারাপ কথাবার্তা, আর নারীদেহ নিয়ে গবেষণা! আমি এখনো অবাক হই, জীবনে কেউ কাউকে দেখে নাই, এমন তিনটা ছেলে কিভাবে প্রথম দেখাতেই "ঐসব" নিয়ে কথা বলা শুরু করে!!!
এবারো খারাপ পুলাপানের দলে পড়ে গেলাম। আস্তে আস্তে আমাদের রুমের রিফাতও আমাদের সাথে যোগ দিল। জানা গেল, সে মস্ত বড় গল্পকার! মানে "ঐসবের" গল্পকার! আমাদের ক্লাস সেভেনের রুম লীডার জুবায়ের ভাই রুমে না থাকলেই রিফাত আমাদের "ঐসবের" গল্প শোনাত!
তবে ব্যাটা ধরা খায় নাই কোন দিন, শুধু আমাকে হাউজ লীডার রাফি ভাই একবার ধরে ফেলেছিলেন, উনি উনাদের ব্যাচের বিদায়ের সময় আমার ডাইরীতে লিখেছিলেন, "বাপজান, নারী বিষয়ে এখনই এত ইন্টারেস্ট! বড় হলে তো আমাদেরও ছাড়িয়ে যাবি! ভাল হয়ে যা!"
সেই সাথে নতুন ক্লাস সেভেনকে ডেকে তৎকালীন ক্লাস টুয়েলভের ভাইয়ারা (৩১ তম ব্যাচ, নরজুল হাউজ, সেলিম স্টাফের উচ্চারণে) হাউজ ট্যালেন্ট শো করালেন (গান গাও, জোক্স বল ইত্যাদি ইত্যাদি.. যেইটাকে আইইউটিতে র্যাগ দেওয়া বলে!) সাকেব ভাই আর আশিক রেজা ভাইয়ের কথা মনে আছে, বাকিদের চেহারা ভুলে গেছি, তাই মনেও নেই সেই দিন সেই রুমে কারা কারা ছিলেন।
দেখতে দেখতে সেই প্রথম সাতদিন কেটে গেল। কিন্তু কে জানত যে, শুধু সেই প্রথম সাত দিন নয়, সেই জেলখানায় বাকিজীবনের জন্য আটকা পড়ে গেছি আমি। ছয়বছর পরে সেখান থেকে শরীরটা বের হয়ে গেলেও মনটা চিরকালের জন্য আটকা পড়ে গেছে সেই ৯৫ একর জায়গায়। আজ মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের ৫০ বছর পূর্তি! ৫০টা ব্যাচের সবগুলো ছেলের সেই একই গল্প, সেই একই হাসি কান্না! কলেজে রিইউনিয়ন হচ্ছে এবার সেই উপলক্ষ্যে। নিশ্চয়ই নানান রঙের ঝলকানি, আলোকসজ্জা, মিউজিক আর আতশবাজিতে মুখর হয়ে আছে মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ।
আর আমি সেখান থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের এক ঠান্ডা দেশে বসে আছি, চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার, নিঃশব্দ!
ফটো ক্রেডিটঃ প্যানারোমিও
প্রুফ রিডিং ক্রেডিটঃ ফারহানা (আমার বউ)