টপিকঃ আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৭)
মন্টানার চার মাস:
প্রথম থেকেই শুরু করি। বাংলাদেশ থেকে মন্টানায় যাওয়াটা খুব ঝামেলার, একটু কম জনপ্রিয় স্টেট হওয়ায় ফ্লাইট কম, ভেঙ্গে ভেঙ্গে যেতে হয়। এর উপর টিকেট কেটেছিলাম ৭ দিন আগে কারণ আমি ভিসাই পাই I-20 তে উল্লেখিত শেষ তারিখের ১৬ দিন আগে। চাইলে এক্সটেনশন করা যেত কিন্তু প্রথমবার যাচ্ছি তাই ঝামেলায় জড়াতে চাইনি। আমার ফ্লাইট ছিল ঢাকা-দুবাই, দুবাই-সান ফ্রান্সিসকো, সান ফ্রান্সিসকো-ডেনভার, ডেনভার-বোজম্যান। প্রায় আড়াই দিনের ফ্লাইট। বোজম্যান এ যখন পৌছাই তখন সম্ভবত রাত ৮/৮.৩০। ইউনিভার্সিটি থেকে লোক এসেছে নিতে। আসার আগে এম.এস.ইউ এর বাংলাদেশ স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন এর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শেফা আপু'র সাথে যোগাযোগ করেছিলাম। উনি পি.এইচ.ডি করছেন। উনি আমাকে সবার নাম জানালেন, ফোন নাম্বার দিলেন, কিছু সাজেশন দিলেন। এছাড়াও উনি ওখানে সবাইকে জানালেন যে আমি আসছি। আহসান আন্কেল আর রুমা আন্টি তাদের বাসায় আমার জন্য রান্না-টান্না করে অস্থির অবস্থা। ভেবে দেখেন এই আন্টি যিনি আমাকে দেখেনওনি সেই আমার জন্য রান্না করে আমাকে রিসিভ করার জন্য অপেক্ষা করছিলেন সবাইকে নিয়ে, কতটা ভালো মানুষ হলে এমনটা কেউ করে.....আমি এগুলোর কিছুই জানতাম না। শেফা আপু শুধু আমাকে আহসান আন্কেল এর বাসার ঠিকানা দিয়ে বলেছিলেন, যে রিসিভ করতে আসবে তাকে বোলো এখানে ড্রপ করে যেতে। ওনারাও আমাকে পিক-আপ করতে চেয়েছিলেন কিন্তু ওনাদেরকে চিনি না তখন, কিভাবে এত ঝামেলা দেই.....আমাকে পিক-আপ করতে এসেছিল আরেক স্টুডেন্ট। ওকে আহসান আন্কেল এর ঠিকানা দেয়ায় ও বলে "দেখো আমার দায়িত্ব তোমাকে ডর্ম পর্যন্ত পৌছে দেয়া, তোমার নাম ওখানে রেজিস্ট্রেশন করানো। অন্য কোথাও ড্রপ করতে পারব না আমি" কি আর করা.....বললাম তোমার ফোনটা দাও তাদের বলি যে আমি আসছি। সোনার কপাল আমার, হাতে নিলাম আর আমার ফোন এর চার্জ শেষ হয়ে গেল। আর ওপেন হলো না। ওনাদেরকে আর জানানো হলো না। রাস্তায় যেতে যেতে আমি পুরাই হতাশ, কারণ চার দিকে ধু ধু করছে, কিচ্ছু নাই কোথাও, রাস্তায় আমাদেরটা ছাড়া দূর দুরান্তে অন্য কোনো গাড়িও নাই। সত্যি বলতে কি আমার ধারণা ছিল সিটি হোক অথবা রুরাল এরিয়া, আমেরিকায় সব জায়গাতেই বড় বড় বিল্ডিং থাকবে। যাই হোক হতাশা নিয়েই ওর সাথে ডর্মে গেলাম। প্রথমে আমাকে কিছুদিনের জন্য রস্কি হলে রেখেছিল। ১ সপ্তাহ পর নর্থ হেজেসে উঠি। রস্কিতে যখন রুমে জামা-কাপড় খুলে বসি, খিদায় তখন সারা শরীর কাপতেছে। বাসা থেকে আম্মু ফ্রায়েড রাইস, চিকেন ফ্রাই, কাবাব দিয়ে দিয়েছিল। তারাতারি ওগুলো খুললাম। ফ্রোজেন করার কারণে একদম শক্ত হয়ে আছে। নিচে গেলাম কোনো ওভেন আছে নাকি দেখতে, ইনচার্জে থাকা ছেলেটা আমাকে এমন এক মান্দাতা আমলের বিশাল ওভেন দেখাল যা আমি জীবনেও ব্যবহার করিনি। জানি না কেন পৌছানোর পর এত আরষ্ট লাগছিল যে ওই ছেলেটার কাছে হেল্প চাইতেও লজ্জা লাগছিল। মনে হচ্ছিল কি না কি ভাবে !!! শেষ পর্যন্ত ওই ঠান্ডা খাবারই খেয়ে ফেললাম। আহ কি যে স্বাদ লেগেছিল........মনে হচ্ছিল আম্মু পাশে বসে খাওয়াচ্ছে খাওয়ার শেষে একটু জিনিসপত্র গুছিয়ে জানালা দিয়ে তাকালাম বাইরে, যতদুরে দেখা যায় কোথাও কেউ নেই, চারিদিক বরফ পরে সাদা হয়ে রয়েছে, সবাই ছুটিতে থাকায় পুরো রস্কি হলে পিনপতন নিস্তব্ধতা। চারিদিকে কেমন যেন মৃত ভাব। ব্ল্যাকহোলের মত ওই রুমটায় যেন নেমে এসেছিল কফিনের একাকিত্ব, যার মাঝে নির্জনতা আমার গলা টিপে ধরেছিল.....কেন যেন কান্না আসছিল অসম্ভব...........
পরের দিন সকালে ডর্মের ফোন থেকে কল করলাম শেফা আপুকে। উনি বললেন আসছেন একটু পর। আমার ধারণা ছিল পি.এইচ.ডি করছেন নিশ্চই চশমা পরা ভারিক্কি চেহারার কেউ হবেন. ওমা দেখি ছোট খাট বাচ্চা-বাচ্চা চেহারার একটা মেয়ে, সাথে গম্ভীর চেহারার গোমড়ামুখো একটা ছেলে। ইনিই রাশেদ ভাই। নতুনদের সামনে উনি এরকম স্পেশাল চেহারা বানান ভারিক্কি ভাব বজায় রাখার জন্য। এমনিতে ওনার মত মাই ডিয়ার টাইপ মানুষ কমই আছে। যাই হোক শেফা আপু গাড়িতে করে আমাকে ইন্টারন্যাশনাল অফিসে নামিয়ে দিলেন। ওখানের কিছু ফরমালিটিস শেষ করা বাকি ছিল। রাশেদ ভাই আমার সাথেই ছিলেন। ব্যাপক মুডের সাথে এইখানকার পরিস্থিতি বলছিলেন। আমি মনে মনে বলি শেফা আপু কার সাথে আমাকে রেখে গেলেন। রাশেদ ভাই আসে পাশের কিছু জায়গা চিনিয়ে আমাকে নিয়ে গেলেন আহসান আন্কেল এর অফিসে। ওখানেই জানতে পারলাম কাল সারা রাত ওনারা আমার জন্য অপেক্ষা করেছেন। একটু পরেই দেখা হলো দিশার সাথে। দিশা আমার সাথে একই সেমিস্টারে আসছে, তিন দিন আগে। তারপর তিনজন মিলে বাসে করে চলে গেলাম মল এ। প্রথম জরুরি জিনিস সেল ফোন কিনতে। বলে রাখা ভালো বোজম্যান এ বাস সার্ভিস ফ্রি। ট্যাক্স এর টাকাতেই বাস সার্ভিস অপারেট করা হয়। রাস্তায় বাস স্টপ এ দাড়িয়ে থাকবেন, বাস এলে উঠে পরবেন, স্টপেজ এলে নেমে যাবেন। ব্যাস, নো কোশ্চেন আস্কড। দিশাকে ওর ডর্মে নামিয়ে দিয়ে সবশেষে চক্কর মারলাম রাশেদ ভাইয়ের বাসায়। এরমধ্যে ওনার মেকি ভারিক্কি ভাব অনেকটাই উধাও হইছে, কিঞ্চিত আছে। দুই বেডরুমের গ্রাজুয়েট এপার্টমেন্ট। উনি আর মিশু একসাথে থাকেন। আমার জন্য রাশেদ ভাই খিচুরী আর মুরগির মাংশ রান্না করলেন। উফ দেশী স্টাইলের সেই সেই গরম গরম খাবার খেয়ে মনে হচ্ছিল বেহেস্তিখানা খাচ্ছি। ইচ্ছা করছিল রাশেদ ভাইকে জড়িয়ে ধরে একটা ডিসকো নাচ দেই। বাসায় ফোন দিলাম, জানালাম পৌছে গেছি, যে সব ঠিকঠাক আছে। রুমা আন্টির সাথে কথা বললাম। এর এক অথবা দুইদিন পর ওনাদের বাসায় যেয়ে সবার সাথে পরিচয় হয়.......কার্নি, ইকবাল আরো যারা ছিল........এছাড়া আরো একজন ছিলেন মাকসুদ ভাই, দ্যা ওয়ান এন্ড ওনলি মাকসুদ ভাই, যাকে আমরা ডাকতাম গুরু বলে। উনি ঐসময় ক্যালিফোর্নিয়ায় বোনের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। আহসান আন্কেল এর বাসায় সবাই পুরা গোবেচারা ভাব নিয়ে বসে আছে, যেন কেউ ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না। এর মধ্যে ইকবাল আমাকে ফিসফিসিয়ে বলল- "বাজে অভ্যাস টভ্ভাস আছে নাকি?" আমি বলি মানে কি? বলে মদ সিগারেট খাও নাকি? আমি শুকনো গলায় বলি সিগারেট তো খাই। ও গম্ভীর হয়ে বলে "খারাপ, খারাপ.....মিশু ভাই আর মাকসুদ ভাইয়ের ও এই অভ্যাস আছে"। আমি তখন মনে মনে প্রমাদ গুনতেছি আর ভাবছি এ কাদের সাথে এসে পরলাম !!!!! তাও সুদূরে একটা আশার আলো এই যে, দুইজন অন্তত সিগারেট খায়। এরাই ভরশা। যারা স্মোক করেন তারা জানেন যে বিশেষ বিশেষ সময় ছাড়া সবসময় একা একা স্মোক করা কত পেইনফুল। রুমার আন্টির বাসায় চরম খাওয়া দাওয়া হল। আন্টির রান্না ছিল খুবই মজার। আন্টি জানেন না আমরা সবাই মুখিয়ে থাকতাম কখন আহসান আন্কেল তার বাসায় দাওয়াত দিবেন। আমাদের এই আশার আগুনে আরো বাতাস দিয়ে আহসান আন্কেল বলতে গেলে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই আমাদের বাসায় ডাকতেন। ওনাদের দুই ছেলে, তুর্য আর দীপ্র। এই দম্পতি গল্প করতে অসম্ভব পছন্দ করতেন, কত ধরনের গল্প তাদের বাসায় হয়েছে। ওনারা অনেকদিন যাবত আছেন। কত অভিজ্ঞতার কথা বলতেন, একদম ঘরের মানুষ মনে করে ওনাদের ছবি, ভিডিও দেখাতেন আর এর মাঝে রুমা আন্টির খাবার আসতেই থাকত। মাত্র সুস্বাদু হরেক রকম খাবার গলা পর্যন্ত খেয়ে শরীরটাকে কোনমতে সোফা পর্যন্ত নিয়ে গেছি, তখনি রুমা আন্টি পিছন থেকে বলে উঠবেন "এই পায়েশ আর আইসক্রিম আছে কিন্তু, ফ্রিজ থেকে জুস বের করে নাও" কি আর করা.....লাগে রাহো মুন্না ভাই..........এরকম দাওয়াত এক-দুই সপ্তাহ অন্তর অন্তর থাকতই। আমেরিকায় অল্প কিছু সুখের স্মৃতির মধ্যে রুমা আন্টিদের বাসার আড্ডা অন্যতম। কিছুদিন পর মাকসুদ ভাই ফেরত আসলেন। দেখা করতে গেলাম। অনেক লম্বা, চিকন চাকন মানুষ। আমাদের অনেক সিনিয়র ছিলেন। উনি ও বুয়েটিয়ান। মেকানিকাল ইন্জিয়ারিং এর ছাত্র। খুব পার্ট নিয়া বললেন- "আসছ, থাক ভালো মত। শীতের কাপড় আনছ তো বেশি কইরা? এইখানে কিন্তু অনেক শীত। হেলথ ইন্সুরেন্স নিয়া নিও, এইটা কিন্তু খুব জরুরি"। বলেই ফিক করে হাসি। রাশেদ ভাইয়ের মত এতক্ষণ ভারিক্কি ভাব ধরে রাখা সম্ভব হয়নি এই মজার মানুষটার পক্ষে। পরে জেনেছিলাম ওনাদের কারোরই হেলথ ইন্সুরেন্স নাই। হেলথ ইন্সুরেন্স করা ম্যান্ডাটোরি হলেও বাংলাদেশে করা আছে, ঐটা এইখানেও কাভার করবে, এইসব ভুজুং ভাজুং দিয়া চালিয়ে দেয়া যায় তবে অসুস্থ হলে খবর আছে।
চলবে......
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৩)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৪)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৫)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৬)