টপিকঃ আমিই অরণ্য - বিবাহ পর্ব ১
ইয়ে, নিজের ব্যাক্তিগত বিষয় নিয়ে লেখার ব্যাপারে বেশ দ্বিধায় ছিলাম। বিয়ে করে আমি নিজেও একটু বেশি লাফালাফি করেছিলাম, ফলে ফোরামের দু'একজনের অনুরোধ। শেষে লিখেই ফেললাম। সবাই একটু সহজ ভাবে নিয়েন।
বিয়ের আগে
আমরা পরস্পরের সাত বছরের পরিচিত। বা সাত বছরের প্রেমও বলা যায়। তবে আমি প্রেমিক হিসাবে খুব খারাপ, সন্দেহ নাই। বিশেষত পুতুপুতু ধরণের গাছতলার প্রেম আর মোবাইলে আড্ডা দেওয়াতে সাংঘাতিক অরুচি। আর আমি সব সময় চেয়েছি সত্যিকারের কিছু ভাল কাজের সাথে জড়িয়ে থাকতে। তাই প্রেম করার চেয়ে এ ধরণের কাজে আগ্রহ আর উৎসাহ অনেক বেশি থাকত। ফলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পরও দেখা যেত আমাদের মাস খানেক কোন সরাসরি যোগাযোগ নেই। আমি নাটক, রক্তদান আর দাফন নিয়ে ব্যস্ত।
তিনি আমার এইসব অত্যাচার খুব সহজ ভাবেই মেনে নিয়েছেন। আমাকে এই কাজগুলি করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। আর সবচেয়ে বড় কথা আমার অনেক সীমাবদ্ধতা, এগুলোকে তিনি কখনই বড় করে দেখেননি। আমি উনার কাছে কৃতজ্ঞ। থ্যাংকস গড!
যাইহোক আমরা দ্রুতই বিয়ে করতে চাচ্ছিলাম। বিশেষত গত কয়েক মাস ধরে লক্ষ্য করলাম- বিয়ের পাত্র হিসাবে না হোক প্রেমের পাত্র আমি খুব একটা খারাপ না। কিন্তু আমি তাহমিদের মত স্মার্টও না।
তাই ভাবলাম দ্রুত বিয়ে করে ফেলা সব দিক থেকেই ভাল হবে।
আমি একটা জিনিস শিখেছি- কাছের মানুষদের কাছে নিজেকে যত সহজ ভাবে আর পরিষ্কার করে উপস্থান করা যায়; ভুল বুঝাবুঝি তত কম হয়। দীর্ঘ মেয়াদী সম্পর্ক গুলির ক্ষেত্রে এর কোন বিকল্প নেই। আমি চাকুরীতে ঢুকে মাত্র কয়েক মাস হয়েছে। এ অবস্থায় আমার সামর্থও বেশি না। আমি তাকে খোলাখুলি ভাবে সব কিছু বললাম। নিজের সামর্থের কথা জানালাম। বললাম এ অবস্থায় তিনি বিয়েতে রাজি আছেন কিনা।
ব্রাশু ভাইয়ের কাছে এটা অবশ্য রিতীমত ব্ল্যাকমেইল মনে হয়েছে। আসলে বিষয়টা তা না। আমি নিজেকে পরিষ্কার ভাবে উপস্থাপন করতে চাইছিলাম। অন্যের সহায়তায় নিজেকে নিজের চেয়ে বড় কিছু হিসাবে না। আর বিনয়ের সাথে জানাচ্ছি, আমি বিয়েতে আমার বউ আর হাতঘড়ি (এটা বলে নিতেই হয়!) ছাড়া শশুর বাড়ি থেকে আর কিছুই নেইনি।
যাই হোক উনার সম্মতি পাওয়ার পর বাবাকে জানালাম বিয়ে করতে চাই। মা একদম শুরু থেকেই সব জানতেন। আমি জানতাম বাবা উনাকে পছন্দ করবেন। কিন্তু তারপরও বলতে গিয়ে পেটে গুড়গুড় করছিলো। তো সাহস করে একদিন রাতে খাবার পর (এ সময় বাবার মুড সবচেয়ে ভাল অবস্থায় থাকে ) বলেই ফেললাম। উনি খুশি হয়েছিলেন আমার পছন্দে। এর পর সব দায়িত্ব তিনিই নেন।
আমাদের বিয়ের তারিখ ঠিক হয় ১২.৩.১৩।
শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ!
এখন হরতালের মৌসুম! পরিবেশ গরম। সে সময় সাঈদীর রায় পরিবেশ শুধু গরম না, উত্তপ্ত। আমার শ্বশুরবাড়ি দিনাজপুর। প্রথমে ঠিক করা হয়েছিল- সড়ক পথে বাস/মাইক্রো যোগে বিবাহ করতে যাব। কিন্তু গন্ডগলের মধ্যে কেউ যেতে চাচ্ছিল না। এজন্য বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে ট্রেনের চিন্তা করা হলো। বিয়ের ঠিক আগের দিন বিএনপি হাস্যকর ভাবে হরতাল ডেকে বসল। ফলে ট্রেনে করে যাওয়া হবে ঠিক হলো।
পরিকল্পনা এমন- আমরা সকাল ৫.৪০ এর ট্রেনে পার্বতীপুর যাব। সেখান থেকে আবার ট্রেনে করে (বিকাল চারটার) দিনাজপুর যাব। পরিকল্পনা মাফিক আমরা নীচের ট্রেনের মত এক ট্রেনে (এই ট্রেন না কিন্তু) যাত্রা শুরু করলাম শ্বশুরবাড়ির (হবু) উদ্দেশ্যে।
এ্যাম্বুলেন্স
আমার বড় ভাই চাকুরী সুত্রে বর্তমানে দিনাজপুর আছেন গত মাস থেকে। বিয়ের পর উনার বাসায় উঠব এমন পরিকল্পনা। তাই ভাইয়া দিনাজপুরেই ছিলেন। আমাদের ট্রেন হিলি পার হয়েছে, এমন সময় ভাইয়ার ফোন- ট্রেনে করে পার্বতীপুর না গিয়ে আমরা যেন ফুলবাড়ীতে নেমে যাই। ভাইয়া এ্যম্বুলেন্স নিয়ে আসছেন। আমাদের এ্যাম্বুলেন্স করে সরাসরি দিনাজপুর নিয়ে যাওয়া হবে। এতে করে আমরা দেড়টার মধ্যেই দিনাজপুর পৌছে যাব। বিকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করার দরকার নেই।
ভাইয়ার কথা মত আমরা সবাই ফুলবাড়িতে নেমে গেলাম। স্টেশনে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর দেখি ভাইয়া এ্যম্বুলেন্স নিয়ে চলে আসলেন। এ্যম্বুলেন্স দেখে আমার ছোট ভাই আর ভাবী হাসাহাসি করতে গিয়ে ভাইয়ার কাছে রাম ধমক খেল। পথে নাকি তাদের বেশ কয়েকবার পিকেটাররা আটকিয়েছিল। 'রুগী আনতে যাচ্ছি' বলে ছাড়া পেয়েছেন।
এ্যম্বুলেন্সের ড্রাইভারের সাথে কথা বলে ঠিক কারা হলো এজনকে রুগী সাজিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। পথে আমরা যেন হাসাহাসি না করি এ জন্য বারবার সতর্ক করে দিলেন। আমি যেহেতু অভিনয় মোটামুটি ভালই পারি, তাই ঠিক হলো আমি রুগী সাজব। (আসলে আমি শুয়ে যাওয়ার সুযোগ নিতে চাচ্ছিলাম )
এ্যম্বুলেন্স চলতে শুরু করল। আমি শুয়ে আছি। ইন খুলে দিয়েছি, জুতা খুলে ব্যাগে ঢুকান, মাথার চুল এলোমেলো। আমার পাশে আমার এক ছোট ভাই বসে আছেন। ঠিক করা হয়েছে পিকেটাররা আটকালে সেই ছোট ভাই খবরের কাগজ দিয়ে বাতাস করবেন আর আমি রুগীর মত অভিনয় করব। যা কথা বলার ভাইয়া করবে। রাস্তায় আমাদের শুধু মাত্র একবার আটকিয়ে ছিল। কিন্তু আরণ্যকের অভিনয় ধরতে পারা, মুশকিলই নেহি, নামুনকিন হ্যায়।
এ্যাম্বুলেন্সের এম্বুলেন্স!
দিনাজপুর থেকে আর মাত্র মিনিট বিশেকের পথ বাকি, এমন সময় আমাদের বহনকারী এ্যাম্বুলেন্স নষ্ট হয়ে গেল। আমাদের মাথায় হাত। আল্লাহর শুকরিয়া, আমাদর এ্যাম্বুলেন্স চালক খুব আন্তরিক ছিলেন। তিনি ফোনে আর একটা এ্যাম্বুলেন্স ব্যাস্থা করলেন। মাঝখান থেকে আমরা আধাঘন্টার অনাকাক্ষিত যাত্রা বিরতি পেলাম। এ সময় আমি বিভিন্ন ধরণের রোগীর ডেমো দিয়ে আমার দুশ্চিন্তাগ্রস্থ ভাইয়ার মুখে হাসি ফুটাতে বাধ্য করলাম।
দুটার দিকে আমরা দিনাজপুরে, ভাইয়ার বাসায় পৌঁছালাম। এরপর ফ্রেশ হয়ে প্রস্তুত হলাম বর বেশে যাত্রা শুরু করার জন্য।
ঘোড়ার গাড়ি
হরতালের জন্য কোন গাড়ি পাওয়া গিয়েছিল না। ভাইয়াকে বললাম বিয়ে করতে যাব কিভাবে? ভাইয়া প্রথমে বলে মটর সাইকেল করে। পরে বলে রিক্সা করে। ভাবলাম ভালই তো, বেশ একটা নতুন পদ্ধতিতে বিয়ে হবে। ভাইয়ার বাসা থেকে বের হতেই দেখে চমৎকার সাজানো একটা ঘোড়ার গাড়ি দাড়িয়ে আছে।
আসলে ভাইয়া অনেক আগে থেকেই এটা ঠিক করে রেখেছিলেন। সারপ্রাইজ দিবেন বলে জানাননি। নিঃসন্দেহে সারপ্রাইজটা পছন্দ হয়েছিল। হাসি মুখে ঘোড়ার গাড়িতে চেপে বসলাম। দেখেন খুশিতে কেমন চোখ বন্ধ হয়ে গিয়েছে-
ছবিতে আরণ্যকের পাশে বসে আছেন প্রজন্ম ফোরামের অনিয়মিত পাঠক এবং অতি অনিয়মিত লেখক/ ফোরামিক। উনার আর একটি পরিচয়, উনি আরণ্যকের ভাবী।
এরপর ঘোড়ার গাড়ি করে রওনা দিলাম কমিউনিটি সেন্টারের উদ্দেশ্যে। বিবাহ করার নিয়তে।
মুক্ত কর ভয়। আপন মাঝে শক্তি ধর, নিজেরে কর জয়॥"