টপিকঃ টোটেম (২য় অংশ)
( পূর্বকথা...
- কি জন্যে তোমার গল্পটা আমাকে বলা জরুরী বলে মনে হচ্ছে তোমার কাছে?
- স্যার, এটার উপর আমার জীবন নির্ভর করছে।
মিসির আলী খানিক্ষন চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন
-চা টা শেষ কর। তারপর শুরু কর। কিন্তু মনে রাখ, আমি কোন সমাধান হয়তো নাও দিতে পারি।
ছেলেটা এক চুমুকে চা টা শেষ করে বলল
-আচ্ছা, সমস্যা নাই স্যার। আমি শুরু করছি।... )
- রতনগড়ে আমি ছোটবেলা থেকে থাকলেও সেখানে আমাদের নিজেদের বাড়ী নাই। অবশ্য ওখানে আমার মামা খালাদের ফ্যামিলি থাকে। যাওয়ার মতন তেমন আহামরী কোন যায়গা অবশ্য না, আপনি তো নিজে গিয়েই বুঝেছেন। রতনগড়ের ওস্তাদ চৈতন মিয়ার কথা হয়তো স্যার শুনেছেন। আপনি ওখানে যখন গেলেন, তখন আপনাদেরকে উনার কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। আসলে আমিও উনার কাছে আগে কখনো যাইনি। তবে শুনেছি অনেকেই উনার কাছে দূরদূরান্ত থেকে যায়। তিনি আসলে পেশায় একজন ওঝা। কিন্তু কিছু গায়েবী বিদ্যাও তার নাকি জানা আছে বলে শুনেছি। তবে জনসম্মুখে নাকি কখনো তেমন প্রকাশ করেননা। কিন্তু অবাক ব্যাপার যে তার পসার সে তুলনায় তেমন ছিলনা। এমনিতে এমন তন্ত্র মন্ত্র ট্রিক জানা থাকলে মানুষ কোটি টাকা কামাইয়ের ফন্দি করে। কিন্তু উনি একটা পয়সাও কারো কাছ থেকে নিতেননা। এজন্যই নাকি যে মানুষজন তাকে পাত্তাও কম দিত। তবে গ্রামের কারো না কারো বাসা থেকে তার খাবার সময়মত চলে আসত, আর তার থাকার যায়গা দিয়েছিলেন হেডমাস্টার সাহেব, তাঁর নিজের একটা পরিত্যক্ত জমিতে। প্রায় দশ বছর ধরে তিনি ওখানেই থাকতেন। একবার আমার খালাতো ভাইয়ের পেটে ব্যাথার চিকিৎসা তিনি করেছিলেন। শহর থেকে ডাক্তাররা বলেছিল তার নাকি বাঁচার কোন আশা নেই। খালার মন মানেনি তাই শেষ চেষ্টা হিসেবে উনার কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। ঠিক কি চিকিৎসা করেছিলেন জানা নেই, তবে আমার ভাইটি তারপর বেঁচে উঠেছিল। যারা যারা উনার কাছে চিকিৎসা নিয়েছিলেন, বেশীরভাগকেই বলতে শুনেছি যে উনার চিকিৎসা নাকি তেমন ব্যার্থ হয়না।
- তোমার খালাতো ভাই মনে হয় এখন বেঁচে নেই?
- কিভাবে বুঝলেন স্যার?
- তুমি বললে যে সে বেঁচে উঠেছিল। এখন বেঁচে থাকলে হয়তো এভাবে বলতে না।
- স্যার ঠিকই ধরেছেন। বছর চারেক পর সে সাপের কামড়ে মারা যায়। তবে ওটা ভিন্ন কথা। চৈতন মিয়ার চিকিৎসা নিয়ে বেশীরভাগ মানুষেরই কোন সংশয় ছিলনা। আমি এসব অলৌকিক জিনিস ঠিক মানতে পারিনা। কোন প্র্যাক্টিকাল ব্যাপার তার চিকিৎসায় অবশ্যই আছে বলে আমি মনে করতাম, কিন্তু এ নিয়ে কখনো ঠিক সেরকম গভীর ভাবে ভেবে দেখা হতনা। অনেকবার তার কাছে গিয়ে বসে থেকে তার কার্যপদ্ধতি দেখব ভেবেছি। কিন্তু যাব যাব করে আর যাওয়াই হয়ে উঠেনি। এসব বিষয়ে অবশ্য কমলের প্রচন্ড আগ্রহ ছিল। আপনারা চলে আসার সময় সে বলেছিল পরে এক সময় সে অবশ্যই আসবে আর চৈতন মিয়া কে দেখে যাবে। এসেছিলও ঠিক তার পরের বর্ষায়। সেবারই প্রথম তাকে নিয়ে আমি চৈতন মিয়ার কাছে যাই। তবে আমি ভেবেছিলাম কমল শুধুই চৈতন মিয়াকে দেখার আগ্রহে এসেছে, পরে শুনলাম তার নাকি গলায় ক্যন্সার ধরা পড়েছে, আগে আমাকে বলেনি। সে চৈতন মিয়ার কাছ থেকে চিকিৎসা নিতে চায়। আমার না করার প্রশ্নই আসেনা। তাকে নিয়ে রওনা হলাম পরদিন দুপুরে।
এমনিতে গেলে ঘন্টাখানেক রিকশায়, আবার পরে আড়াই ঘন্টা হাঁটা পথ যেতে হয়। আমি একটা মোটর সাইকেল যোগাড় করতে পেরেছিলাম। তবুও ভালই সময় লাগল আমাদের পৌঁছাতে। একটা নড়বড়ে সেতু পার হবার ঠিক পরেই কিছুটা জঙ্গুলে মতন জায়গায় চৈতন মিয়া থাকেন। গ্রামের ঠিক আশেপাশেই না হলেও তেমন দূরেও নয়। কোন সাগরেদ টাগরেদ নেই। একাই থাকেন। আমরা উপস্থিত হলাম সাড়ে চারটা, পাঁচটার দিকে। চৈতন মিয়া ঘরেই ছিলেন। আমাদের কথা শুনে বললেন যে ঐদিন ঠিক তার চিকিৎসা টিকিৎসা করার ইচ্ছা ছিলনা। আমরা বললাম যে অনেক দূর থেকে এসেছি। একটু অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও শেষে রাজি হলেন। আমাদেরকে ভেতরে বসিয়ে কমলের অসুখ সম্পর্কে বিস্তারিত শুনে বললেন যে প্রস্তুত হতে ঘন্টাখানেক সময় লাগবে। আমরা যেন বাইরের ঘরে বসি। আমি সুযোগ বুঝে বললাম যে তার চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে আমি জানতে আগ্রহী, আমি সামনাসামনি দেখতে পারব কিনা? শুনে উনি একটু হেসে বললেন যে সবকিছু সবার জন্য না। আরও অনুরোধ করলে শেষে বিদায়ই করে দেয় নাকি, এ জন্য আর জোরাজোরি করলামনা।
ঘন্টাখানেক পর ডাক পড়ল। কমলকে তিনি পরিষ্কার একটা গামছা হাতে দিয়ে গোসল করে আসতে বললেন। পাশের গোসলখানাতে দেখি পানি, সাবান রেডীই করা ছিল। কমল কোন কথা না বলে তাড়াতাড়িই গোসল করে এল। তারপর একটা গ্লাসে করে চৈতন মিয়া কি জানি নিয়ে কমলকে এনে দিলেন, ভাং হবে বলেই আমার মনে হল। যাই হোক, সে কোন উচ্চবাচ্য না করেই খেয়ে নিল। তারপর চৈতন মিয়া বলল যে রোগীকে এখন তার চিকিৎসার ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকতে হবে। এটা শেষ হতে হতে বেশ লম্বা সময় লাগবে। আমাকে ধৈর্য্য ধরে বাইরের ঘরে থাকতে বললেন তিনি। চিকিৎসার ঘরে তিনি বাইরের কাউকেই ঢুকতে দেননা। আমি আর কি করব, বাইরের ঘরে শুয়ে শুয়ে বোধহয় ঘুমিয়েই পড়েছিলাম।
প্রায় রাত নয়টার দিকে আমাকে চৈতন মিয়া ডেকে তুলল। একটা ট্রেতে করে তিনি একটু ডাল, ভাত আর সবজি এনেছেন, আমাকে খেয়ে নিতে বললেন। আমি ভাল করে তাকে লক্ষ্য করতে দেখি তার গায়ে অস্বাভাবিক ভাবে তেল মাখা। কপালে, কানের পাশে কোথাও গ্রিজের মত জমে আছে। আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বললেন যে কমল ভাল আছে। আর ঘন্টাখানেক বিশ্রাম নিলেই একদম ঠিক হয়ে ফেরত যেতে পারবে। তারপর আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তিনি ভেতরে চলে গেলেন।
- যে তেল তুমি তার গায়ে দেখেছ, তার কি কোন নির্দিষ্ট রঙ ছিল বলে বলতে পারবে?
- আমার যতদূর মনে পড়ে স্যার, ওটা কিছুটা সাদাটে রঙের ছিল। যদিও একটু পরেই যখন পানি দেবার জন্য চৈতন মিয়া এল, তখন আর তেমন কিছুই দেখিনি। ঠিক আগের মতন শুকনা খটখটে।
- আচ্ছা, বলে যাও।
- আমি প্রায় খাওয়া শেষ করেছি, এমন সময় মুষল ধারে বৃষ্টি নামল। এদিকে কমল দেখি ততক্ষনে উঠে চলে এসেছে। হয়তো এতক্ষন ঘুমিয়েই ছিল, কিন্তু তাকে দেখে অনেক ক্লান্ত মনে হল। চৈতন মিয়া এগিয়ে এসে বললেন যে আগামীকাল সকালের আগে সে যেন কিছু খাওয়া দাওয়া না করে। আর আমাদেরকে চলে যেতে হবে, ঝড়-বৃষ্টি যাই হোক না কেন আমাদেরকে রাতে থাকার মত ব্যাবস্থা তিনি করে দিতে পারবেননা। কি আর করা, বৃষ্টি মাথায় নিয়েই আমি আর কমল বেরিয়ে পড়লাম। কমলকে এর ভিতর জিজ্ঞেস করলাম যে তার কেমন বোধ হচ্ছে, সে বলল মাথা একটু ধরে আছে, কিন্তু এছাড়া একদম ঠিক। আমি জানতে চাইলাম ঘরটা কিরকম বা ঐ লোক কিভাবে কাজ করে কিছু বুঝতে পেরেছে নাকি? জবাবে সে বলল আবছা ভাবে যতটুকু মনে পড়ে, ঐ লোক শুধু চুপচাপ বসে ছিল আর হাতে হাত ঘষাঘষি করছিল। আমার একটু অবাকই লাগল। ভাবলাম পরবর্তীতে ওর কাছ থেকে এসব বিস্তারিত শুনে নেয়া যাবে।
যাই হোক, সাঁকোটার কাছে এসে বিপদে পড়ে গেলাম। বৃষ্টিতে সাঁকোর অবস্থা পুরোপুরি খারাপ। প্রচণ্ড পিছল হয়ে গেছে আর মোটর সাইকেল নিয়ে উঠতে মনে হল ভেঙ্গেই যাবে। আমি কমলকে বললাম হেঁটে পার হয়ে যেতে, আমি মোটর সাইকেল হাঁটিয়ে নিয়ে আসছি। সেতুর মাঝামাঝি না আসতেই শেওলায় আমার পা পিছলে গেল। কোন রেলিঙও ছিলনা যে ধরব। নিচে ঠিক খাল ছিলনা, তবে বর্ষা কাল জন্যে প্রায় হাঁটু পানি তো ছিলই। আমি তাল সামলাতে না পেরে নিচে পড়ে গেলাম। আর মোটর সাইকেলটাও সঙ্গে পড়ে গিয়ে তার পিছনের চাকাটা সজোরে আমার পাঁজরের উপর গিয়ে আড়াআড়িভাবে পড়ল। নিজেই টের পেলাম পাঁজরের অনেকগুলা হাড় একসাথে ভেঙ্গে গেল। প্রচন্ড ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে সঙ্গেসঙ্গেই জ্ঞান হারালাম।
চলবে...