টপিকঃ গোলকের ব্যাস আট ইঞ্চি
লিকলিকে শরীরের জাহিদ বলটাকে ডিবক্সের ঠিক বাইরে রেখে ফ্রী-কিকের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইনজুরী টাইমের শেষ মিনিটের খেলা চলছে। এই মুহূর্তে খেলার স্কোর ২-২। বক্সের সামনে প্রতিপক্ষ দলের প্লেয়াররা দেয়াল তৈরী করছে। প্রতিপক্ষ গোলকিপার সমানে চিৎকার করে করে দেয়ালের পজিশন ঠিক করার চেষ্টা করছে। স্টেডিয়ামের গুটিকয়েক দর্শক চিৎকার করে আকাশ ফাটাচ্ছে। রুদ্র মাহাদী চৌধুরী সাইড লাইনের ঠিক পাশে থাকা ডাগআউটের একটা চেয়ারে বসে, দুই হাতের উপর নিজের মাথাটা ভর দিয়ে রেখে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। দর্শকের বা প্লেয়ারদের চিৎকার কোন কিছুই মাহাদীর কানে যাচ্ছে না। স্থির দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে ফ্রি-কিক নেয়ার দৃশ্যের দিকে। রেফারী ফ্রি-কিকের বাশি বাজালো। জাহিদ ছুটে আসছে ফ্রি-কিক করতে.........
মাস ছয়েক পূর্বেঃ
হঠাত করে গায়ের উপর কোন কিছুর ভারে ঘুম ভেংগে গেলো মাহাদীর। চোখ খুলে দেখে তার একমাত্র ভাতিজী রুমু ওর গায়ের উপর উঠে সমানে লাফাচ্ছে আর বলছে, “তাতা, ওতো। তাতা, ওতো না...”। সব বাচ্চাকাচ্চা মাহাদীকে যমের মত ভয় পেলেও, কোন এক অজানা কারণে ওর তিন বছর বয়সী একমাত্র আপন ভাতিজী ওকে বিন্দুমাত্র ভয় পায় না। মাহাদী নিজেও কোন এক অজানা কারণে ওর উপর চেষ্টা করেও রাগ করতে পারে না। মাহাদী রুমুকে পেটের উপর বসিয়ে বলে ওঠে,
- আবে, ব্যাথা লাগেতো! ঐ, এই ভোর বেলায় এসে আমার ঘুম ভাঙ্গাইছিস কেন?
- বালোতা বাদে। ওতো ওতো ওতো। দাদীমা লাগ কলবে।
রুমুর সাথে কথা বলতে বলতেই ভাবী এসে মাহাদীর ঘরে ঢোকে।
- কি হে হিরো, ঘুম ভাংলো অবশেষে?
- তোমার মেয়ে কি আর শান্তিমতো ঘুমাতে দেয়? আগে আম্মা ঘুমাতে দিতো না, আর এখন তোমার মেয়ে দেয় না। বালোতা নাকি বাজে?
- হা হা হা। ওতো খালি বারোটাই চেনে। সবসময় নাকি বারোটা বাজে।
- ভাইয়া অফিসে গেছে?
- হম্ম। তাড়াতাড়ি ওঠ। এগারোটা বাজে। মা এর মেজাজ খারাপ হওয়ার আগেই উঠে পর। নাস্তা করে নে তাড়াতাড়ি।
- হম্ম। উঠছি।
বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতেই চোখ পড়লো মোবাইলের উপরে। মিসকল এলার্টের লাইটটা জ্বলছে। চেক করে দেখলো ছয়টা মিসকল উঠে আছে। সামরিনা মনেহয়, ভাবলো মাহাদী। মেয়েটা সপ্তাহখানেক ধরে প্রতিদিনই কল দিচ্ছে। বিভিন্ন জিনিস নিয়ে আলাপ করে। কোন ঠিক-ঠিকানা নাই। কিন্তু নাহ। মাহাদী অবাক হয়ে দেখলো, হাসান কল দিয়েছিলো। রাত থেকে ছয়বার। যেই হাসানের সাথে বছরখানেক ধরে কথা হয় নাই, সেই হাসান ছয়বার কল দিয়েছে! পরে কল ব্যাক করার কথা চিন্তা করে মোবাইলটা টেবিলের উপর রেখে দেয় মাহাদী।
নাস্তার টেবিলে প্রতিদিনের মতো আজও রুমু ওর সঙ্গী। নিজের বেবীফুড বাদ দিয়ে মাহাদীর নাস্তা খাওয়া রুমুর প্রতিদিনের রুটিন হয়ে গিয়েছে। এই সময় মায়ের সাথে দেখা হয়ে যায় মাহাদীর।
- ঘুম ভাঙলো আমার রাজপূত্রের?
- হম্ম।
- গতকাল কয়টায় ঘুমিয়েছিস?
- তিনটা।
- কি করিস এত রাত জেগে বুঝি না। এখনতো পড়িসও না।
- কিছুই করি না। কম্পিউটারের স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে স্ক্রীন রিফ্রেশ করতে থাকি।
- গতকাল কোন একটা ইউনিভার্সিটি থেকে কল এসেছিলো ল্যান্ডফোনে। তোকে জয়েন করতে বলেছে। তুই ভাইভা দিলি কবে? কিছুইতো দেখি আজকাল আর আমাকে জানানো জরুরী মনে করিস না।
- এমনি ভাইভা দিসিলাম। তাই বলি নাই। সিরিয়াস কিছু না।
- সিরিয়াস কিছু না! আচ্ছা, বুঝলাম। তা, কবে জয়েন করবি?
- জয়েন করবো না।
- কি!! মানুষ চাকরী পায় না। আর তুই জয়েন করবি না! এইসব খামখেয়ালীপণা করলে চলবে?
- ভালো লাগে না আম্মা। কিছু ভালো লাগে না।
- কি ভালো লাগে তোর? মাস্টার্স শেষ করলি। রেজাল্টও তোর মোটামুটি ভালোই। চাকরী না করলে, বাইরে যা। আইএলটিএস দিয়েছিলি, ওটার রেজাল্ট দিয়েছে?
- হম্ম।
- এটাও আমাকে জানাস নাই! রেজাল্ট কি?
- সেভেন পয়েন্ট ফাইভ।
- আমাকে জানাস নাই কেন?
- কারণ আপনাকে জানালে আমাকে বাইরে অ্যাপ্লাই করার জন্যে পাগল করে ছাড়বেন, তাই।
- তোর আব্বার কত শখ ছিলো যে তুই বাইরে যাবি। পড়বি।
- আব্বার কথা চিন্তা করেই কিন্তু আমি মাস্টার্সটা কমপ্লিট করলাম।
- হ্যা। এখন বাইরে যা। আমিতো আর তোকে বাইরে থাকতে বলছি না।
- আম্মা, আমি আপনাকে বুঝায় বলতে পারবো না। জাস্ট......পারবো না। কিছু ভালো লাগে না। আসলে......... আমি জানিনা যে আমি আসলে কি করবো।
তড়িঘড়ি নাস্তা শেষ করে মাহাদী চলে যায়। মিসেস চৌধুরী দুঃখিত চোখে তাকিয়ে থাকেন ছেলের চলে যাওয়ার দিকে। রুমুর মা এসে আলতো করে হাত রাখে তার শ্বাশুরীর কাধে। নীরবে যেন বলার চেষ্টা করে যে, সব ঠিক হয়ে যাবে।
প্রতিদিনের মত আজও ঘর থেকে বের হয়ে কোথাও যাওয়ার জায়গা খুজে পায় না। গ্র্যাজুয়েশনের পরে আর ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসেও যায়নি ও। বন্ধুরা অনেক অনুরোধ করে। ও সারা দেয় না। কেমন যেন স্বার্থপরের মতন লাগে ওর নিজেকে। আজও যাওয়ার কোন জায়গা খুজে না পেয়ে ইন্ডোর স্টেডিয়ামের দিকে হাটা ধরে। ভিতরের গ্যালারীতে বসে ভালোই টাইম-পাস করা যায় পোলাপানের জুডো-কারাতের হাই-হুই কসরত দেখে। কখনো বাস্কেটবল খেলা হয়। সেটা দেখতেও মন্দ লাগে না। ইনডোরে পৌছে দেখে যে, কোন খেলা হচ্ছে না। পোলাপান জুডোর প্র্যাকটিস করছে। সেটা দেখতে দেখতেই ওর হাসানের কথা মনেহয়। কল-ব্যাক করার দরকার। কল দেয় ও হাসানকে। কল ধরেই হাসান বলে ওঠে,
- কি সৌভাগ্য আমার। গ্রেট রুদ্র মাহাদী চৌধুরীর সময় হলো আমাকে কল-ব্যাক করার!
- খেয়াল করি নাই। ফোন সাইলেন্ট করা ছিলো।
- কেমন আছিস?
- ভালো।
- সত্যি?
- হম্ম।
- যাইহোক, ফ্রী আছিস?
- এই মুহূর্তে ফ্রী না।
- কি করিস যে ফ্রী না?
- পোলাপানের হাই-হুই কসরত দেখি গ্যালারীতে বসে।
- হা হা হা। আচ্ছা। বিকেলে ফ্রী আছিসতো? নাকি তখনও ফ্রী না?
- হম্ম। ফ্রী আছি।
- ঠিক আছে। তাহলে বিকেলে সিটি-ক্লাবের মাঠে থাকিস। কথা আছে।
- ওকে।
- সী ইউ ম্যাডি। বাই।
- বাই।
[চলবে]