টপিকঃ ঈগল জেগেছে!
(ফুল রেজুলুশনের জন্য ফটোতে ক্লিক করুন)
পেডেস্টালের ওপর দাম্ভিকের মত দাঁড়িয়ে দানবীয় ঈগল, বিশাল ডানাগুলো মেলে উড়তে যাচ্ছে বুঝি...
ঈগল জেগেছে!
The eagle has risen!
ডানা-যুক্ত রুপকথার কাল্পনিক প্রাণীর মত পেডেস্টাল থেকে ঊড্ডয়োন্মুখ বস্তুটি আর কিছুই নয় – শীতল গ্যাসপুঞ্জ আর ধূলিকণার ম্যাসিভ ক্লাউড। নক্ষত্রের নার্সারী হিসেবে পরিচিত ঈগল নেবুলার কেন্দ্রীয় অংশ ছবির দাম্ভিক গ্যাস দানবটি।
দানবীয় টাওয়ারটির উচ্চতা ৯.৫ আলোক বর্ষ, বা ৯০ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার। আমাদের হোম-স্টার সূর্য হতে সবচাইতে নিকটবর্তী নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টরাই-এর দূরত্বও ঈগল টাওয়ারের দৈর্ঘ্যের অর্ধেক।
ধূলিকণা, হিমশীতল হাইড্রোজেন, হিলিয়াম এবং অন্যান্য আয়োনাইজড গ্যাসের সুবিশাল মেঘপুঞ্জ – এর বৈজ্ঞানিক নাম নেবুলা। নেবুলাকে বলা হয় নক্ষত্রদের নার্সারী।
গ্র্যাভিটি (অভিকর্ষ) বলের প্রভাবে নেবুলার গ্যাস ও ডাস্ট পার্টিকল এবং অন্যান্য ম্যাটেরিয়াল একত্রে জোটবদ্ধ হয়ে ভরবিশিষ্ট ম্যাস তৈরী করে। ক্রমে এই নবগঠিত ম্যাসটি চারপাশ হতে আরো পদার্থ (গ্যাস, ডাস্ট) আকর্ষণ করে নিজের বুকে টেনে নিতে থাকে। চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে ম্যাসটির ঘনত্ব এবং আয়তন। অন্তহীন কালের চাদরে গ্র্যাভিটি নিজের হাতে এভাবে গড়ে তোলে তারকাদের।
নেবুলার গর্ভে জন্ম নিতে থাকে অসংখ্য নতুন নক্ষত্র। নেবুলার গর্ভে বুভুক্ষু নবোজাত নক্ষত্র, প্রোটো-নক্ষত্রেরা বাড়তে থাকে দিনে দিনে। নেবুলায় অবস্থিত ম্যাসিভ পরিমাণের শীতল হাইড্রোজেন গ্যাস ও পুঞ্জীভূত ধূলিকণা ভক্ষণ করে পুষ্ট হতে থাকে।
পৃথিবীর মানুষদের কাছে সবচাইতে জনপ্রিয় স্টার নার্সারী হলো ঈগল নেবুলা (সিরিয়াল নং: M16) । ঈগল নেবুলার স্টার ক্লাস্টারে আনুমানিক ৪৬০-এর অধিক তারকা আছে। সবচাইতে বড় তারকাটি আমাদের সূর্যের চাইতে ৮০ গুণ ভারী, ঔজ্বল্যের দিক দিয়ে সূর্যের তুলনায় ১০ লক্ষ গুণ উজ্বল! অথচ এই তারকাটির বয়স মাত্র ১ থেকে ২ মিলিয়ন বছর।
ছবির দানব গ্যাস-টাওয়ারটির মাথা ও ধড়ের দিকে দেখুন – বেশ কিছু উজ্বল আলোর গোলক দেখা যাচ্ছে। ওগুলোই নবোজন্ম নেয়া শিশু তারকা। ঈগল নেবুলার নার্সারীতে হিমশীতল হাইড্রোজেন গ্যাসের চাদরে মুড়ে ওরা বড় হয়ে উঠছে। উত্তপ্ত, নবীন নক্ষত্রদের একটি গ্যাং নেবুলার মাথাটি খেয়ে নিচ্ছে, জোরালো আল্ট্রাভায়োলেট রেডিয়েশনের ব্যান্ড বিচ্ছুরিত করে স্পটলাইট ফেলে রেখেছে অংশটুকু।
ম্যাসিভ হাইড্রোজেন ও ধূলো মেঘের গাঢ় পটভূমিতে নবীন তারকাদের আলোক রশ্মি যেন ফ্যান্টাসীর একটি চমৎকার, এ্যাবস্ট্রাক্ট ওয়ার্ক অব আর্ট তৈরী করেছে!
ঈগল নেবুলার এই গ্যাস টাওয়ারটি অসংখ্য নতুন তারকার ইনকিউবেটর হিসেবে কাজ করছে। নেবুলার মধ্যভাগের গাঢ় অংশটিতে কত নতুন তারকার জন্মের প্রস্তুতি চলছে কে জানে?
যেসব নক্ষত্রেরা ক্রুদ্ধ আলোর চিৎকার ছিটিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে, ওরা হলো প্রথম ব্যাচের নক্ষত্র। পাইপলাইনে আছে আরো অনেক ব্যাচ।
টাওয়ারের মধ্য ও নিম্নভাগে অঙ্গুলীর মত প্রোযেকশন ও বাম্পগুলো দেখতে পাচ্ছেন? ওগুলো হলো তারাদের সক্রিয় বার্থিং বেড। দেখতে খুব ছোট্ট লাগছে বটে; জেনে রাখুনঃ গ্যাসের আঙ্গুলগুলো আমাদের সৌরজগতের চাইতেও বৃহত! ভ্রুণ নক্ষত্রগুলো বিপুল পরিমাণে গ্যাস উদরস্থ করে “দেহ” গঠন করছিলো –ব্যাকগ্রাউন্ডের দূর স্টার ক্লাস্টারের আলোর পটভূমিতে প্রজ্বলিত হওয়ায় ধরা পড়ে গেছে শিশু তারকাদের babycot-গুলো।
যেসব নক্ষত্র ইতিমধ্যে জন্ম নিয়ে উত্তপ্ত আলোর বর্শা ছুঁড়ে গ্যাস মেঘ বিদীর্ণ করে দিচ্ছে, আয়রণীকালী ওরাই আরো নতুন নক্ষত্র সৃষ্টি করতে ইন্ধন জোগাচ্ছে। টাওয়ারের মাথায় দেখুন বেশ কিছু বিরাট বিরাট প্রজ্বলিত ক্লাম্প আছে, কিছু জায়গায় আঙ্গুলের মত প্রোজেকশন গজিয়েছে। আশে পাশের তারকাগুলো এই অঞ্চলের গ্যাস উত্তপ্ত করে দিচ্ছে, সৃষ্টি করে চলেছে একটি গ্যালাক্টিক শক ফ্রন্ট। নেবুলার টপ-লেফট কর্ণারে দেখুন উত্তপ্ত, শুভ্র গ্যাসপুঞ্জের রিম দিয়ে আচ্ছাদিত টাওয়ারের মাথাটি। আমরা জানি, গ্যাসকে উত্তপ্ত করা হলে সে বিপুল পরিমাণে প্রসারিত হয়। উত্তপ্ত, ক্রুদ্ধ গ্যাসপুঞ্জগুলো ব্যাটারিং র্যামের মত করে ভেতরের শীতল, কালো গ্যাস মেঘপুঞ্জকে চেপে ধরছে। প্রচন্ড চাপের ফলে ভীষণভাবে কম্প্রেসড হচ্ছে ওখানকার গ্যাস – নতুন তারকা সৃষ্টির জন্য উর্বর ক্ষেত্র! নব তারকার জন্ম দিতে দিতে টাওয়ার মস্তকের এই শক ফ্রন্ট-টি ধীরে ধীরে নামতে থাকবে পায়ের দিকে – প্রতি মুভমেন্টে জন্ম হবে আরো অনেক নক্ষত্রের।
ছবির ডমিন্যান্ট কালারগুলো আসলে বিভিন্ন এনার্জাইযড গ্যাসের সিগ্নেচার – প্রতিবেশী স্টার ক্লাস্টারের শক্তিশালী আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মির দ্বারা আলোকিত হয়ে উঠেছে। মাথার নীল রঙের মুকুটটি উত্তপ্ত অক্সিজেনের, নিম্নাঙ্গের লাল নাড়ীভুড়ীগুলো তপ্ত হাইড্রোজেন।
৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে ঠিক এরকমই একটি স্টার নার্সারীর কোলে জন্ম নিয়েছিলো আরেকটি শিশু নক্ষত্র...
আমাদের প্রিয় সূর্য
পিএসঃ ছবিটি নভেম্বর, ২০০৪-এ নাসার হাবল স্পেস টেলিস্কোপ দিয়ে তোলা।