টপিকঃ শুভ নববর্ষ ১৪১৯!
আজ পহেলা বৈশাখ, ১৪১৯ সাল। দেখতে দেখতে নতুন বাংলা বছর চলে এলো। ফোরামের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক একটা বার্তা দিতে হয়। কিন্তু কী দেয়া যায় ভাবছি। নতুন বছরে যাই বলি না কেন গতবাঁধা কিছু কথাই আসবে। এই যেমন, অনাগত দিনগুলো ভালো যাক ইত্যাদি, ইত্যাদি। সেগুলো আর বলতে চাই না। একটু অনানুষ্ঠানিক কায়দায় কিছু বলি, কেমন?
১৪১৯ সাল। সালটির দিকে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রই। কোথা দিয়ে এতগুলি বছর হাওয়া হয়ে গেলো! সত্যি বলতে গেলে আমার কেবল ১৪০০ সালটির কথাই ভালো মনে আছে। ঐ যে কবিগুরু লিখেছিলেন না...
“আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি,
কৌতুহল ভরি,
আজি হতে শতবর্ষ পরে”
(১৪০০ সাল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
সেবার বেশ ঘটা করে নববর্ষ পালিত হয়েছিলো। অনেক আনন্দ করা হয়েছিলো। সেসব এখন অতীত। সে যাক গে, ইংরেজি সালের সর্বব্যাপী আগ্রাসনে পুরো বছরটাতেই বাংলা সণ অবহেলিত থেকে যায়। সত্যটা অনেকেই হয়তো স্বীকার করবেন না। কিন্তু ক’জন বুকে হাত দিয়ে বলবেন – বাংলা বছরের কোনো একটি দিনের তারিখ ঠিকঠাক বলতে পারবেন? আমি অন্তত পারবো না। আসলে পারা যায় না। এই ব্যাপারটা আমাকে বেশ পীড়া দেয়। একবারে দৈব চয়নের মত একটা দিন নিয়ে অনেকবার পরীক্ষা করে দেখেছি। ফলাফল? প্রতিবারই পরাস্ত হয়েছি, কিন্তু সাফল্যের মুখ দেখি নি। অনেকে নিষ্ঠার অভাব বলতে পারেন কিংবা অসচেতনতা? অথবা, ভালোবাসার অভাব? হতে পারে এর যেকোন একটা কিংবা সবগুলিই। কিন্তু যে যাই বলুক, ভালোবাসার অভাবটা কেন জানি মানতে পারি না কোনোভাবেই। আর কেউ না জানুক, ভেতরে ভেতরে এটা তো সবাই জানি নিজের ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টিকে আমরা ঠিক কতটা ভালোবাসি! এটা আসলে পুরোপুরি বোঝানোর মত ব্যাপার নয়। সবার আগে আমরা বাঙ্গালী, তারপর অন্য আর সব কিছু। তখন মনটা একটু শান্ত হয়। অন্তত চৈত্র সংক্রান্তিতে তো মনে হয়, এটাই বা কম কীসের?
একবার আমার এক চৈনিক সহকর্মী - শোইয়াং, চাইনিজ নতুন বছরে কী কী করে তার গর্বিত বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে ফিরতি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি একটুও বিচলিত হলাম না। চিত্র কথার থেকে শতগুণ বেশি বোঝাতে পারে – এই আপ্ত বাক্যটিকে স্মরণ রেখে কেবল গুগলে একটা অনুসন্ধান চালালাম। তারপর বর্যবরণের নানা আয়োজনগুলো দেখে ওর চোখ তো পুরো ট্যারা! যদিও পান্তা কী বস্তু – এটা বোঝাতে আমাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিলো। শেষে স্বীকার করলো – এতো বর্ণিল আয়োজন – সত্যিই মুগ্ধ করার মত। তখন গর্বে আমার বুকের ছাতি ৩ ইঞ্চি বেড়ে গিয়েছিলো! সেবারকার পহেলা বৈশাখের মত খুশী আর বোধকরি কখনো হই নি!
একটা কথা খুব শোনা যায় – সংস্কৃতিকে লালন করতে হবে, ধারণ করতে হবে। আমি এটাকে একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করি। লালন করাটার অর্থ এই নয় যে, হাজার বছরের জিনিস নিয়ে পড়ে থাকতে হবে। সময় পিছু ফিরে দেখে না। যুগও সতত পরিবর্তনশীল। কালক্রমে নতুন নতুন ধারণা আসবে, সেটা পোশাকে হোক, কিংবা খাবারে, অথবা, চালচলনে। এটাই স্বাভাবিক, নয়তো এখনো দাঁত দিয়ে মাংস ছিঁড়ে খেতে হতো। এটাই প্রগতিশীলতা এবং বহির্বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে এর প্রয়োজন আছে বৈকি! কিন্তু ঐতিহ্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে নয়। পশ্চিমা বিশ্বে কিছুদিন থাকার সুবাদে দেখেছি, পশ্চিমারা কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়তো আমূল বদলে গেছে, কিন্তু ঐতিহ্যের ব্যাপারে কোনো ছাড় দেয় না। যখনই কোনো ঐতিহ্যগত উৎসব এসেছে, সেগুলো ওরা সাড়ম্বরেই পালন করেছে, আকাশ-পাতাল পার্থক্য থাকা সত্বেও! একটা দিনের জন্য হলেও মনে রেখেছে এবং সেটাকেই ওরা বড় মনে করে!
এখান থেকে আমার একটা ধারণা হয়েছে – আমরা যে দেশে ঢালাওভাবে বলিঃ দু’দিনের বাঙ্গালী সেজেছে – এটা আসলে বলাটা ঠিক নয়। জানি, অনেকেই বলবেন – লোক দেখাতে, রঙ-তামাশা করতে আসাটায় ওভাবে বলাটা কী এমন অসংগত? আমার কথাটা সেটা নয়, ইতিবাচকভাবে দেখলে দেখা যাবে, তবুও তো অনেকে আসছেন। মেয়েরা শাড়ি পরছেন, ছেলেরা পাঞ্জাবি...পান্তা-ইলিশ-ভর্তা সহযোগে মাটির শানকিতে খাওয়া, মেলা, বাঁশি, আল্পনা, গান, আবৃত্তি... একটা দিন নতুনতর দুনিয়ার আগ্রাসী চলন-বলন শিকেয় তুলে শেকড়ের কাছে ফিরে যাওয়া! ভাবনাটা নতুন আলোয় দেখে আমি বরাবরই শিহরিত হয়ে যাই।
আসল হলো গিয়ে - শেকড় ভুলে না যাওয়াটা। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিষয়টাকে এভাবে দেখা যাক – অগ্রগতিকে যদি একটা ব্যাসার্ধ বরাবর সম্প্রসারণের সাথে তুলনা করা যায় (যেমন, বেলুন), তাহলে একটা সময় পর কেন্দ্রের কথা বিস্মৃত হলে, কেন্দ্রের বন্ধুসুলভ চাপ মাথায় না রাখলে, ক্ষমাহীণ বহির্বিশ্বের নির্দয় চাপে যাবতীয় প্রগতির ফানুস ফুটো হয়ে যাবে। তাই মূল যেখানে, সেখানের কথা স্মরণ রাখা চাই। যত যাই করি, নিজের বাঙ্গালী পরিচয় ভুলে যাওয়া চলবে না। বাঙ্গালী চরিত্র যেমনই হোক, সত্যটাকে স্বীকার করে নিলেই মঙ্গল। ভালো হোক, মন্দ হোক, আত্মপরিচয়ে গৌরবের থেকে মহান কিছু নেই!
যাহোক, অনেক কথা বললাম। কারো কারো হয়তো ইতোমধ্যে মাথা ধরতে শুরু করেছে। পরিশেষে শুধু এটুকু বলিঃ আমাদের অপ্রাপ্তি অনেক থাকতে পারে, ব্যর্থতাও অনেক, কিন্তু ঐতিহ্যে আমরা কারো থেকে পিছিয়ে নেই। আসুন বাঙ্গালী চেতনাকে যে যেভাবে পারি, ধারণ করি – যতটুকু পারা যায়, ততটুকু। যে যার সাধ্যমত বাঙ্গালী পরিচয়কে ভবিষ্যত প্রজন্মের মাঝে দায়িত্বশীলতার সাথে সঞ্চার করি।
এই আশাবাদ নিয়ে সবাইকে প্রজন্ম ফোরামের পক্ষ থেকে শুভ নববর্ষ ১৪১৯! সবাই ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন।
---------------------------------------------------------------------------------------------------
উদাসীন
তৃষ্ণা হয়ে থাক কান্না-গভীর ঘুমে মাখা।