টপিকঃ বিরাট একটা দান মারলাম!! সাবাশ আমি!!!
বড় একটা দান মারলাম!! সকাল থেকে মনটা খুবই খুশি খুশি লাগছে। এসব কাজ সাধারণত আমাকে দিয়ে হয় না। সারাজীবন দেখলাম- আমার চোখের সামনে আমারই খেলার সাথীরা মাছ ধরে নিয়ে বাসায় যাচ্ছে, আম গাছের নীচে গেলেই আম কুড়িয়ে পাচ্ছে, পরিক্ষার হলে নির্বিকারে নকল করে যাচ্ছে। আমি আম গাছের ধারেকাছে গেলেই বাড়ির ভেতর থেকে পিঁড়ি বা মুগুর উড়ে আসত, সময় দেখার জন্য পকেটে হাত দিলেই পরিক্ষার হলে মোবাইল নিয়ে যেত। আমি কখনোই আক্ষেপ করতাম না; হয়তো সেটার প্রয়োজনীয়তাই বুঝতাম না। এক বন্ধু বলেছিলঃ "তলে তলে সবাই টেম্পু চালায়, আমি চালালেই হরতাল"।
কিন্তু আজ এরকম একটা দান মারতে পারব কখনই ভাবিনি। গতকাল এক আঁতেল লোক এসেছিল। আমি তাকে বলেছিলাম যে, কারো পুরোনো কম্পিউটার আছে কী না। আমার একটা লাগবে। নির্বিকার ভঙ্গিতে বলেছি। জানতামই, ওনার কাছে বলে কোন লাভ হবে না। সেদিন এই আঁতেল সাহেব কিছুই বলেন নি। কিন্তু আজ এসেই সে কী হাত কচলানি রে বাবা! মুখ থেকে দন্তবাহার বিকশিত হয়েই চলেছে। আমি ভুরু কুঁচকে বললামঃ "কী হয়েছে?"। তিনি দন্তবাহার আরও একটু বিকশিত করে বললেন তাঁর নাকি একটা কম্পিউটার আছে, বিক্রি করবেন। এমনভাবে বললেন, যেন তাহার সুহাস বদন প্রত্যক্ষ করিয়াই আমি তাহার কম্পিউটার কিনিতে রাজী হইয়া যাইব।
আমি কি এতই বোকা? গর্ধবটাকে বুঝতে দিলাম না কম্পিউটারটি যে এ-মুহূর্তে আমার কতটা প্রয়োজন। ভাবলেশহীন ভাবে বললামঃ "আপনার কম্পিউটার বিক্রী করবেন তো গতকাল বলেননি কেন?"। প্রশ্নটা শুনে তিনি তাঁর মুখের ধনুকাকৃতির হাসিটার বক্রতা কিঞ্চিৎ বৃদ্ধি ছাড়া আর কিছুই করলেন না। আমিও আরেকটু বিরক্ত হয়ে বললামঃ "আপনার কম্পিউটারের কনফিগারেশন কী?"। তিনি অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে বললেনঃ "ভাই, আমি এসব কিছু বলতে পারব না"। আমি বললামঃ "আচ্ছা ঠিক আছে। কত বেচবেন আপনার কম্পিউটার?"। তিনি অনেক ভয়ে ভয়ে বললেন মাত্র ১২ হাজার টাকা। দাম শুনে আমি একটু নড়ে চড়ে বসলাম। কিন্তু তাঁকে কিছুই বুঝতে দিলাম না। ঠিক করলাম পরদিন তাঁর বাসায় গিয়ে কম্পিউটার দেখে আসব।
মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে গেলাম। যদি দেখি মোটামুটি ভালো, তাহলে দেরী করা যাবে না। সাথে সাথে লেন-দেন সেরে ফেলতে হবে। তাঁর মত এমন গর্দভ আর পাওয়া যাবে না। বিশাল লম্বা বাস ভ্রমণ শেষে এক চিপা গলিতে ঢুকলাম, কিন্তু গলি তো আর শেষ হয় না। অবশেষে একটা ছোট আঙ্গিনা দেখতে পেলাম, যেখানে আঙ্গিনার চাইতে লাল-নীল কাপড়ের টুকরাই বেশী দেখা যাচ্ছিলো। দূর থেকে ভেবেছিলাম আশেপাশে কোন গার্মেন্টস আছে হয়তো। কাছে গিয়ে বুঝলামঃ ওগুলো বাচ্চাদের ইয়ে করা কাঁথা; ধুয়ে শুকোতে দেয়া হয়েছে।
শত "কাঁথা" পেরিয়ে আমি অবশেষে পৌঁছুলাম একটি ঘরে। এ-ঘরে যে থাকে তার একটি কম্পিউটার থাকতে পারে ভাবাই যায় না। উল্লেক্ষ্য, তিঁনি পেশায় একজন মাদ্রাসার শিক্ষক। ভালভাবে কনফিগারেশন দেখলামঃ সেলেরন ২.৯৩ গিঃহাঃ প্রসেসর, ২৫৬ মেঃবাঃ র্যাম, ৮০ গিঃবাঃ হার্ডডিস্ক, সাটা কম্প্যাটিবল মাদারবোর্ড, ১৫ ইঃ মনিটর, স্পিকার, মাউস, কীবোর্ড, ইউপিএস, এবং শেষ দান- কম্পিউটার টেবিল! মনে মনে খুশি হয়ে গেলেও এমন এক ভুরু কুঁচকানি মারলাম, যে দাম এক লাফে ২ হাজার কমে গেল। নিজেকে তখন বীরের মত লাগছিল।
এটা-ওটা পরিক্ষা করে দেখছিলাম, এমন সময় তিন-চার বছরের একটি ছোট্ট মেয়ে তার চেয়েও বড় একটি পানির গ্লাসে পানি নিয়ে অনেক কষ্টে আমার সামনে রাখল এবং প্রায় সাথেসাথেই উঠে গিয়ে দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে পর্যবেক্ষন করতে লাগলো। লাল রঙের হিজাব পরা ফুটফুটে মেয়েটিকে তখন একটি জবা ফুলের কলির মত লাগছিল। ভাবতে লাগলাম, এই মেয়ে এত সুন্দর হলো কী করে? কথাও তো মনে হয় বলতে পারে না ভালোভাবে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে মুখ দিয়ে টিক টিক শব্দ করে নীচুস্বরে বললামঃ "নাম কী?"। ওর মনে হয় আমাকে পর্যবেক্ষণ করা শেষ হয়েছে। একটি মিষ্টি হাসি দিয়ে আমার কাছে এসে বললঃ "জান্নাত"। আমি ভাবছিলাম সব হুজুরের সন্ত্বানদের নামই বোধ হয় আরবী শব্দ দিয়ে হয়।
মেয়েটি থখন ব্যস্ত হয়ে আমাকে তার কম্পিউটারের কোথায় কোন কার্টুন আছে, সিসিমপুর কোথায় আছে, কোন গানের কোন লাইনের পরে কোন লাইন হবে তা বোঝাতে লাগল। যেন একটু পরে আমার এগুলোর ওপর পরিক্ষা হবে; না পারলে ওর মান-ইজ্জত যাবে। কম্পিউটারে ওর আঁকা কয়েকটা ছবি বের করে দেখালো। যখন আমি সব-কটা উইন্ডো মিনিমাইজ করে ডেস্কটপে গেলাম, তখন ও তার নিজের ছবি ওয়ালপেপারে দেখে খানিকটা লজ্জাই যেন পেল। দৌড়ে অন্য রুমে চলে গেল। ফিরে এল কাঁঠাল আর আমভর্তি একটা ট্রে নিয়ে। আমাকে অনেক জোরাজুরি করে দায়িত্ব নিয়ে খাওয়ালো।
এতক্ষনে মেয়েটির বাবা এই রুমে এলেন। দেরী দেখে বুঝতে পারলাম, তাঁর স্ত্রী বাসায় নেই। আমরা যখন লেন-দেন নিয়ে আলাপ করছিলাম, তখন মেয়েটি বড় বড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি ওর দিকে তাকাতে পারছিলাম না, নিজের মধ্যে কেন জানি অপরাধবোধ কাজ করছিল।
গল্পটি এখানেই শেষ হতে পারতো, কিন্তু এটুকুও আমাকে লিখতেই হলো। মেয়েটি একবার আমার দিকে, আবার তার বাবার দিকে তাকাচ্ছিলো। ওর বাবাও মনে হয় আমার টেকনিক ফলো করছিল। কিছুক্ষণ পর স-ব বুঝে নিয়ে মেয়েটি বললঃ "আব্বু, তুমি কি আমার কম্পিউটার বিক্রি করে দিবা?"। আমি লক্ষ্য করলাম, ওর বাবা প্রশ্নটির কোন উত্তর দেননি। মেয়েটি স্বাভাবিক ভাবে "ও, আচ্ছা" বলে অন্য রুমে চলে গেল। আমি ভাবলাম বাহ! বেশ শক্ত মেয়ে তো! আমি যখন প্যাকিং করছিলাম, তখন মেয়েটি আবার এসে অস্বাভাবিক রকম স্বাভাবিক গলায় বললঃ "আব্বু, এই জায়গাটাতো তাইলে খালি হয়ে যাবে। এইখানে তাইলে কী রাখবা?"। এই প্রশ্নটিরও কোন উত্তর দেয়া হলো না। আমি আরও লক্ষ্য করলাম, মেয়েটি আমার সাথে আর কোন কথাই বলছে না।
অস্থির ভাবে ও এ-রুম ও-রুম আসা যাওয়া করছিলো। আমার প্যাকিং করা প্রায় শেষ, তখন ও দ্রুতপায়ে এসে গলার স্বর খানিকটা বাড়িয়ে... নাহ... খানিকটা নয়, অনেকটাই বাড়িয়ে ওর বাবাকে বললঃ "আব্বু, এই আব্বু, আমি তাইলে কার্টুন দেখব কোথায়?"। এবার আর সে স্বাভাবিক থাকতে পারলো না। প্রাকৃতিক নিয়মেই দু-চোখের পানি ছেড়ে দিল। ওর বাবাকে এই প্রশ্নটারও কোন উত্তর দিতে দেখলাম না। এবং আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, আমি এবার ওর বাবার দিকেও তাকাতে পারছিলাম না।
আরে ভাই তাতে কী হইছে? আমি কী দানটা মারলাম দেখেছেন? জীবনে এই প্রথম আমি দান মারলাম। অনেক ভালো হয়েছে, তাই না ভাই? এরকম দান লাখে একটা হয়, ঠিক আছে না ভাই? জিতলাম না ভাই?...