‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই, সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি ।’ আমার বাঁশি মোটেই ডাকাতিয়া নয়। আমি বাঁশি বাজালে অনেকটা ফাটা বাঁশের চোঙ্গা ফোঁকার মত আওয়াজ হয়। অনেক সময় আবার সেটা শোনায় মধ্যরাতের কুকুরের কান্নার মত। আমার বাঁশি একবার শুনলে দ্বিতীয়বার আর কেউ শুনতে চায় না। মাঝে মাঝে আড়ালে গিয়ে হাসাহাসি করে। প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গ ফুটে থাকে তাদের মুখে। ‘আহা রে, কি আমার বাঁশিওয়ালা রে! হ্যামিলনেরটা ফেল!!’
আমি হ্যামিলনের সেই বাঁশিওয়ালার মত হতে চাই না। আমি হতে চাই নিরোর মত বাঁশিওয়ালা, যে কিনা তার সব দুঃখগুলো নিংড়ে ফেলতে পারত বাঁশি বাজিয়ে। পুঞ্জীভূত দুঃখগুলো গলে গলে ঝরে পড়ত তার বাঁশির আওয়াজে। আমি নিরো হতে চাই; কারণ, আমার কষ্টের ভার বড় বেশি হয়ে যাচ্ছে। কষ্টগুলো বুকের ভেতর কেমন গোট পাকিয়ে যাচ্ছে। আচছা, আমার এত কষ্ট কেন?
রাতের বেলা বালিশ ভিজে যাচ্ছে। আমি কান্না সামলাতে পারছি না। আমি তো কাঁদতে চাইনি কখনো। কাউকে কাঁদাতেও চাইনি কখনো। মানুষকে কাঁদতে দেখলে নিজেই কেঁদে ফেলি তো মানুষকে কাঁদাবো কি? আমি কাঁদছি নিজের দোষে। আচ্ছা, এটাকে কি কোন দোষ বলা যাবে? প্রেমে পড়াটা কি খুব দোষের?
দুম করে প্রেমে পড়ে গেলাম। একেবারে আচমকা। সে প্রেম বড় জটিল প্রেম। সে প্রেমে মাংসের চেয়ে মনের ভালবাসা ছিল অনেক বেশি। ছিল বলছি কেন? এখনো আছে। নইলে এত কষ্ট লাগবে কেন? বুকের মাঝে কষ্ট গুলো কেন পাঁজর ফুড়ে বেরিয়ে আসতে চাইবে? রাতের অন্ধকারে মাথার নিচের বালিশটা ভিজতে থাকবে কেন?
সে যখন হাসে আমি জলতরঙ্গ শুনতে পাই। মুখ ভার করলে বুকটা খালি খালি লাগে। আমার দিকে চাইলে আমি আকাশে উড়তে থাকি। মুখ ফিরিয়ে নিলে ভূ-পাতিত হই, শতটুকরো হয়ে।প্রেমে পড়লে মানুষ ভালবাসে সবুজ গাছ, উড়ন্ত পাখি, পূর্ণিমার চাঁদ, স্নিগ্ধ নদী, নরম রোদের বিকেল, লাল লাল ফুল আর রঙ্গিন প্রজাপতি। আমি ভালবেসেছিলাম নীল আকাশটাকে। এখন বাসি ঝম ঝম বৃষ্টি। ঠিক কান্নার মত।
যা ধরে রাখার ক্ষমতা নেই, তা না চাওয়াই ভাল। কেন শুধু শুধু নিজের কষ্ট বাড়াবো? তারচেয়ে আমার কষ্ট আমারই থাক। দুজনে মিলে কষ্ট পাবার চেয়ে একজনের কষ্ট পাওয়াই ভাল। নিজের কষ্টটা সহ্য করতে পারলেও ওরটা পারব না। কি অদ্ভুত! স্বার্থপর হতে পারব না বলে কাঁদছি। কি হাস্যকর! অপরকে কাঁদাবো না বলে নিজে কাঁদছি। আমি বোধহয় সত্যি সত্যিই একটা বোকা। প্রথম শ্রেণীর বোকা।
কাঁদতে আমার ভাল লাগে না। আমি হাসতে চাই। অট্টহাসিতে কাঁপাতে চাই এ বিশ্ব-ব্রহ্মান্ড। পাখির গান আর নদীর কলতান শুনতে চাই। উড়তে চাই মুক্ত ঘুড়ির মত। ঘুরে বেড়াতে চাই ভবঘুরের মত, কোন পিছুটান ছাড়া। কান্নাটাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে চাই হাসির দেশে। যেখানে আমি শুধু হাসব আর হাসব। কান্না পড়ে থাকবে পেছনে। যেখান থেকে আমার হাসির নাগাল পাবে না। হাসির দেশে থাকব আমি আর বাঁশি। নিরোর মত গলিয়ে দেব সব কষ্ট। ছাই করে দেব সব সুরের আগুনে। থাকব শুধু আমি। আর বাঁশি। আরেকটা নিরো হবার অপেক্ষায়। আরেকটা নরম বিকেলের প্রত্যাশায়। নীল আকাশটাকে আরেকবার ভালবাসব বলে।
------------
১৪-০৪-২০০৪
মুল রচনা লেখা হয়েছিল দিনলিপি হিসেবে।
পূর্ব প্রকাশঃ ওমিক্রনল্যাব ফোরাম