দেখো সামিউল, লিনাক্সওয়ালাদের কাছ থেকে একই কথা শুনতে শুনতে সবাই যেমন বিরক্ত হয়ে গেছে, ঠিক তেমনি লিনাক্সওয়ালারা উইন্ডোজওয়ালাদের একই প্রশ্ন শুনতে শুনতে ক্লান্ত। তোমার এসব প্রশ্নের উত্তর বহুবারই দেয়া হয়েছে। উইন্ডোজ-লিনাক্স বিতর্কের প্রতিটি টপিকে এই একই কথা শুনতে হয়েছে সবসময়। সেটা এখানেই হোক কিম্বা আপ্র-তেই হোক না কেন। ভেবেছিলাম সেই একই উত্তর আর দেবো না। তাই চুপ করে ছিলাম। কিন্তু ঘুমাতে পারলাম না, রাত ৩ঃ৩০টায় বিছানা থেকে উঠে লিখতে বসলাম।
যাইহোক, আবারও একটা চেষ্টা করি। একজন মানুষের জীবন ৩৫০গিগা গান সঠিকভাবে শোনার জন্য অত বড় নয়। প্রতিদিন ছয় ঘন্টা ধরে মনোযোগ দিয়ে গান শোনার জন্য সময় দিলেও এতগুলো গান একবার শুনতেই প্রায় ৬০০ দিন বা ২ বছর সময় লাগবে। হ্যাঁ, কেবলমাত্র একবার করে শুনতে। আর এখানেই তো শেষ না এই ৩৫০গিগা ৬০০গিগা হতেও তো আর খুব বেশি সময় লাগবে না। আমি জানি এত গান কেন তোমার দরকার। তবে সেটাও এই চুরি করাটাকে হালাল করে না।
একজন কৃষক যখন তার সমস্ত পরিশ্রম দিয়ে ক্ষেতে আলু চাষ করল, তখন রাতের আঁধারে আমি ক্ষেত সাবাড় করে দিনে বাজারে ন্যায্য মূল্যে বা ফ্রি দিয়ে দিলে সেটা হালাল হবে না। ঠিক একইভাবে একজন শিল্পীর মেধা, পরিশ্রম এবং তার গাঁটের পয়সা দিয়ে বানানো একটা এলবাম বুক ফুলিয়ে পাইরেসি করে রেডিও চালানোটাও ঠিক না।
ঢাকা শহরে তিন রুমের একটা ফ্লাটের ভাড়া ১৫০০০+ টাকা। একজন ট্রাফিক পুলিশের বেতন হয়তো ১০০০০ টাকা (আমি ঠিক জানিনা, অন্যান্য চাকরির বেতনের তুলনায় ধরলাম)। তাহলে এই লোক যদি ঠেকায় পড়ে মটর সাইকেল আটকে অহেতুক জরিমানা আদায় করে বা বাসওয়ালাদেরকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের সুযোগ দেয়ার বদলে টু-পাইস কামাই করে ঢাকা শহরে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে তখন তাকে দোষ দেয়া যায় না, কী বলো? এখানে দেখো, একটার সাথে আরেকটা জোড়া লেগে লেগে মানুষ নিজের বিবেক, নীতি সব হারাচ্ছে।
এগুলো বেশি হাইপোথেটিক্যাল কথা বলে উড়িয়ে দেয়াটা খুবই সহজ। কিন্তু এসব দানা বেঁধেই আজ বাংলাদেশে জীবন যাপন অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে।
এসব গান, সফটওয়্যার চুরি আমার নিজের জীবনে কী রকম প্রভাব ফেলেছে সেটাও একটু বলি। তাহলে এসব হাইপারথিসিসের সাথে কিছু বাস্তবতাও যোগ হবে।
আমার ছোট ভাইয়ের মিউজিশিয়ান হওয়ার প্রচণ্ড ইচ্ছা। আমার নিজেরও সেটাই চাওয়া। আমার কাছে তার মিউজিকের মেধা অতুলনীয় মনে হয়। বহু কষ্ট করে, প্রচুর সময় নিয়ে, ব্যাংকের লোন নিয়ে সে বছরখানেক আগে একটা এলবাম বের করল। মোটামুটি বাজার ধরার মত গান ছিল সেখানে। বাজার কতটুকু পেয়েছিল ঠিক জানি না, কারণ আমি দেশে ছিলাম না। কিন্তু এখন দেশে আসার মাসখানেকের মধ্যে কয়েক জায়গায় ঐ এলবামের গানও বাজতে শুনলাম। অর্থাৎ ধরে নেয়া যায় মোটামুটি চলেছে এলবামটা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো তার ঐ সিডি তেমন বিক্রি হয়নি। মানুষ ঠিকই শুনেছে কিন্তু কিনে নয়। সেই ব্যাংকের লোন সে এখনও পরিশোধ করে যাচ্ছে।
এখন সে দ্বিতীয় এলবামের কম্পোজ শেষ করেছে। টাকার অভাবে মাস্টারিং করতে পারছে না। তারপর তো সিডি বাজারজাত বাকি-ই রইল। এতকিছু করে সে যখন বাজারে সিডিটা ছাড়বে, ঠিক আগের মতই অবস্থা হবে। সেটা সুপারহিট হোক বা সুপারফ্লপ-ই হোক। হয়তো সেই এলবামও তোমার ঐ ৩৫০গিগার সাথে আরও কিছু মেগাবাইট জায়গা যোগ করবে। এভাবেই আমরা উঠতি প্রতিভাকে গলা টিপে হত্যা করে ফেলি।
এবারে এসো সফটওয়্যার পাইরেসির কথায়। আমি, তুমি ফটোশপ, উইন্ডোজ পাইরেসি করলে এডোবি, মাইক্রোসফট পথে বসবে না। তাদের আসলে লাভ বৈ ক্ষতি হবে না। বাসায় যেটাতে চুরি করে অভ্যস্ত হবে, অফিসে সেটা কিনে চালাতে হবে (অবশ্য বাংলাদেশে সেসময় এখনও আসে নাই, তবে আসতে দেরিও নাই)। কিন্তু এই অভ্যাসের ফলে আমার, তোমার বেশ বড় একটা ক্ষতি হয়। সেটা হলো বিবেক বা নীতির বিসর্জন।
এখানে অনেকেই হয়তো জানে বাংলাদেশের স্টক মার্কেটের উপর আমার একটা এ্যপ আছে আইফোন ও এ্যন্ড্রোয়েডের জন্য। আইফোনে আমি একটা ফ্রি ভার্সনের পাশাপাশি একটা প্রো ভার্সনও বানিয়েছিলাম। যারা শখের শেয়ার ব্যবসায়ী তাদের জন্য ফ্রি-টাতে পাঁচটা সিম্বলের রেস্ট্রিকশন দেই। পাঁচটার বেশি কেউ চাইলে তাকে প্রো-টা কিনতে হবে। দাম খুব বেশি রাখিনি - মাত্র ২.৯৯ পাউন্ড। সেই এ্যপের ক্র্যাক রিকোয়েস্ট এ্যপটা বাজারে আসার মাস দুয়েকের মধ্যেই ক্র্যাক ফোরামগুলোতে দেখা যেতে লাগলো। হয়তো এতদিনে ক্র্যাক বেরও হয়ে গেছে, আমি খোঁজ রাখিনি।
যে লোক পাঁচটার বেশি সিম্বল ট্র্যাক করতে চায়, সে নিশ্চয়ই লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছে স্টক মার্কেটে। উপরন্তু অর্ধ লক্ষ টাকা দিয়ে একটা আইফোনও কিনেছে। সে এই এ্যপটা তার প্রয়োজনেই ব্যবহার করতে চাইছে। কিন্তু এটার জন্য ৩৫০ টাকা খরচ করতে তার সমস্যা হচ্ছে। কেন? সেই একই কারণ, সফটওয়্যার আবার কিনে ব্যবহার করতে হবে নাকি! আমি লাখ টাকা খরচ করি তো কী হয়েছে, সাড়ে তিনশো টাক খরচ করে সফটওয়্যার কিনে গাধা হবো নাকি!
গত মাসে আমার এ্যপল ডেভেলপার সার্টিফিকেট ফুরিয়ে গেছে। এখন বলো তো ৯৯ ডলার দিয়ে এই সার্টিফিকেট কিনে সেই এ্যপ, এ্যপস্টোরে চালু রাখার উৎসাহটা আমার কোন পর্যায়ে আছে। অথচ শুরুতে এটাতে অনেক ফিচারই যোগ করার ইচ্ছা আমার ছিল।